গোটা দেশ ঈদ উদযাপন আর নানা আয়োজনে ব্যস্ত। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যস্ত অন্যরকম আয়োজনে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বুধবার এই হাসপাতালে প্রথমবারের মতো অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু হবে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের (বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন) মাধ্যমে ব্লাড ক্যানসার, লিউকোমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, লিম্ফোমা, সিভিয়ার অ্যাপ্লাস্টি অ্যানিমিয়াসহ জটিল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। সফলভাবে কর্মসূচিটি চালু করা গেলে রোগীরা অল্প খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা পাবেন। তাঁদের আর অন্য কোথাও যেতে হবে না।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের সুবিধা চালুর উদ্যোগ এ সরকারের একটি অন্যতম সাফল্য।
জানা গেছে, আজ বুধবার সকালে হাভার্ড মেডিকেল স্কুলের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। তাঁরা বাংলাদেশি চিকিৎসকদের কাজে সহায়তা দেবে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই দলটি ঢাকায় অবস্থান করবে।
এ দলের নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন চিকিৎসক বিমলাংশু দে, অ্যানা ক্যাথেরিন গুডম্যান, ট্র্যাসিলিন হল, মার্টিন ক্যারল, ইরিনা ডোবরাসিন ও লরা ডিলন।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্তরোগবিদ্যা (হেমাটোলজি) বিভাগের প্রধান ও হাসপাতালটির বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন ইউনিটের প্রধান এম এ খান প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ঈদের এক দিন আগেও ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন ইউনিটে সেবিকাদের পরীক্ষা নিতে হয়েছে। দেশে ও বিদেশে চিকিৎসক ও নার্সরা যেসব প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তা ঠিকমতো তাঁরা আত্মস্থ করছেন কি না, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখাই ছিল পরীক্ষার উদ্দেশ্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক রুহুল ফোরকান বলেন, ২০১০ সাল থেকে ইউনিটটি চালুর চেষ্টা শুরু হয়। অবশেষে এটি সফলতার মুখ দেখতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেই। সুব্যবস্থা করা গেলে প্রতিবেশী দেশ ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের তুলনায় অনেক কম খরচে রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন কী?
শরীরে ব্লাড ক্যানসার, লিউকোমিয়া, মাল্টিপল মাইলোমাসহ প্রাণঘাতী রোগের আক্রমণ হলে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতির শিকার অস্থিমজ্জা সরিয়ে সুস্থ অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনই হলো এর উদ্দেশ্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হলেও পাশের দেশ ভারতে ২৮টি কেন্দ্রে এ চিকিৎসা করা হয়। সে দেশে এই চিকিৎসা শুরু হয় ১৯৮৪ সালে।
বাংলাদেশে বছরে ঠিক কী পরিমাণ রোগীর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কারও হাতে নেই। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বলছে, এসব রক্তরোগে প্রায়ই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং অর্থাভাবে অনেক সময় ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ হারাচ্ছে। কেউ কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করে বা ঋণ করে বিদেশে যাচ্ছে চিকিৎসা সেবা নিতে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, ভারতে প্রতিস্থাপনের কাজটি শেষ করতে গড়ে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। সিঙ্গাপুরে খরচ প্রায় এক কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশে খরচ পড়বে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা।
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাথমিকভাবে ১০ জন রোগীকে বাছাই করেছে। ২০-২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এই রোগীদের শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হবে। যাঁরা প্রতিস্থাপনের আওতায় আসছেন, তাঁদের নিজেদের শরীরের স্টেম সেল দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত সেলগুলো সরানো হবে। যেহেতু এই রোগীরাই প্রথম, তাই সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় তাঁদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে
বাংলাদেশে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন ইউনিটের প্রধান এম এ খান। ২০০৭ সালে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল হাসপাতালে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিভাগে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লাভজনক হলেও সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। দেশেই একদিন এই সেবা দেওয়া সম্ভব করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। নিজের খরচে সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষণও নেন। একপর্যায়ে সরকারের কাছে ইউনিটটি চালুর প্রস্তাব দিলে সহযোগিতার আশ্বাস পান।
সরকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল ও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে। ২০১০ সালের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের চিকিৎসক, সেবিকা, মেডিকেল টেকনোলোজিস্টরা বোস্টনে গেছেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকেও চিকিৎসকেরা এসে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে গেছেন বাংলাদেশিদের। শুধু যে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টরাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তা-ই নয়, প্রতিস্থাপনের পর ইনফেকশনের আশঙ্কায় রোগীদের বিশেষ ব্যবস্থায় রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। এসব রোগীর কেবিনে যে বাতাস ঢুকবে, তাও ১০০ ভাগ খাঁটি হতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ-২ এ অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ইউনিটে এমন কক্ষ তৈরি করতে প্রকৌশলীদেরও বিদেশে পাঠানো হয়।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম এ খান বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে এ হবে এক নতুন অধ্যায়।