দেশি কাপড় তৈরিতে শীর্ষে নরসিংদী

কাপড় বিকিকিনিতে ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। গত বৃহস্পতিবার নরসিংদী সদর উপজেলার বাবুর হাটে। ছবি: প্রথম আলো
কাপড় বিকিকিনিতে ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। গত বৃহস্পতিবার নরসিংদী সদর উপজেলার বাবুর হাটে।  ছবি: প্রথম আলো

বৃহস্পতি থেকে শনিবার—সপ্তাহের এই তিন দিন পাইকারি কাপড় বিক্রির হাট বসে নরসিংদী সদর উপজেলার শিলমান্দী ইউনিয়নে। দেশের অন্য সব ইউনিয়নের মতোই এ ইউনিয়নের রাস্তাও কাঁচা–পাকা, অপরিকল্পিকভাবে এবং এমনকি কৃষিজমির ওপরে গড়ে উঠেছে বাড়ি–ঘর। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে এ ইউনিয়ন অনন্য ভূমিকা রাখছে। এখানেই রয়েছে দেশে উৎপাদিত কাপড় বিক্রির সবচেয়ে বড় পাইকারি হাট ‘শেখেরচর-বাবুরহাট’।

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এনসিসিআই ) তথ্য অনুযায়ী, শাড়ি, লুঙ্গি, মেয়েদের থ্রিপিস, বিছানার চাদর, গামছা, রুমালসহ দেশের কাপড়ের চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয় জেলার বিভিন্ন কারখানায়। এর বেশির ভাগ বিক্রি হয় বাবুরহাটে।

ঢাকা থেকে সড়কপথে বাবুরহাটের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই এই হাট। এখানে কাপড় আসে জেলার বিভিন্ন কারখানা থেকে। প্রায় পুরো জেলাতেই আছে সুতা থেকে কাপড় তৈরির কারখানা পাওয়ার লুম (বিদ্যুৎ–চালিত তাঁত)। আগে হাতে তাঁত চালিয়ে সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হতো, এখন বিদ্যুৎ–চালিত যন্ত্রে চলে কাপড়ের বুনন। দিনরাত খটাশ খটাশ শব্দে সুতা থেকে তৈরি হয় নিখুঁত কাপড়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাপড়ের রং হয় ধূসর। ডাইং কারখানায় নিয়ে সেগুলো পছন্দমতো রং করা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে কাপড় যায় হাটে।

নরসিংদী চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কাপড় উৎপাদনের কারখানাগুলো গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত। এর মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের প্রায় সব কারখানার কাপড়ই বিদেশে রপ্তানি হয়। সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে উৎপাদিত হয় স্বল্প পরিসরে। নরসিংদীতে যে কাপড় উৎপাদিত হয়, তার বেশির ভাগই দেশে, বিশেষ করে বাবুরহাটে বিক্রি হয়।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতির দায়িত্বে থাকা ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, নরসিংদী জেলায় ছোট–বড় মিলে প্রায় তিন হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পাওয়ার লুমের সংখ্যাই বেশি। এর বাইরেও আছে টেক্সটাইল, ডাইংয়ের (সুতা-কাপড় রং করা) মতো কারখানাও। এসব কারখানায় দেড় থেকে দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তবে জেলায় অনেকটাই অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

অবশ্য জেলা চেম্বারের কাছে কারখানার যে হিসাব রয়েছে, তার সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যের মিল নেই। অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক আতিকুর রহমান জানান, নিবন্ধিত কারখানার মধ্যে ১ হাজার ৪০১টি পাওয়ার লুম, ৮টি তৈরি পোশাক কারখানা, ৮টি জুট মিল, ৬-৭টি স্পিনিং মিল আছে। তবে নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যার চেয়ে বাস্তবে আরও বেশি কারখানা রয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।

সরেজমিনে গত সপ্তাহে নরসিংদী ঘুরে দেখা গেছে, সদরের চৌয়ালা এলাকায় পাওয়ার লুম বেশি, পলাশ ও ঘোড়াশালে রয়েছে ভোগ্যপণ্যের কারখানা ও পাটকল, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও সার কারখানার মতো ভারী শিল্পও রয়েছে এখানে। শিবপুরের সৈয়দনগরে বিসিক শিল্প এলাকা ও মাধবদীতে টেক্সটাইল কারখানার সংখ্যা বেশি। 

কৃষিতে সমৃদ্ধ নরসিংদীতে এত কাপড়ের কল কীভাবে হলো, সে ইতিহাস বেশ পুরোনো। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে কাপড়ের সবচেয়ে বড় পাইকারি হাটটিই (বাবুরহাট) হয়েছে প্রায় ৭৯ বছর আগে। কালের পরিক্রমায় হাটের পরিসর যেমন বেড়েছে, তেমনি কাপড় উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণেও যোগ হয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার আগে নরসিংদীর পলাশ এলাকায় পাটকল স্থাপন, আশির দশকে বিসিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠাও জেলায় শিল্পের বিস্তারে প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সড়ক ও রেলপথে এখানে যাতায়াতসুবিধাও শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, জেলায় ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সংকটও নেই। তবে বাবুরহাটে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয়। হাটের দিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক শ ট্রাক আসে। এসব ট্রাক পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। বেশির ভাগ ট্রাক মহাসড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় যানজট হয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে নজর দেওয়া।

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের বর্তমান সভাপতি মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জেলার মনোহরদীতে বিসিক শিল্পনগরীর সম্প্রসারণ হচ্ছে, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার অনুমোদন পেয়েছে। ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসারে সরকারি উদ্যোগে এখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন ও দুটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ প্রয়োজন।