দেশভাগ, সিলেটে গণভোট, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হাহাকার

সিলেটের জকিগঞ্জ ও ভারতের করিমগঞ্জকে বিভক্ত করেছে কুশিয়ারা নদী। আগে দুটি স্থানই একই জেলার অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে চলে যায় এ দুটি স্থান।
  প্রথম আলো

দ্বিজাতিতত্ত্ব অর্থাৎ মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত অনেকে ভারতে পাড়ি জমান। একইভাবে ভারত ছেড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত অনেকে পূর্ববঙ্গে আসেন। জন্মভূমি ছেড়ে ভিনদেশে আসা মানুষের এ এক মর্মন্তুদ বেদনার ইতিহাস। দেশভাগের অংশ হিসেবে তখন সিলেটও ভাগ হয়েছিল। তবে একটু ভিন্নভাবে। এখানে হয়েছিল গণভোট।

১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৭৪ বছর আগের গণভোটের সেই ইতিহাস আর সময়টা কেমন ছিল?

সিলেটে গণভোট

দেশভাগের সময় সিলেট জেলা ভারতের আসাম প্রদেশের অংশ ছিল। এই জেলার ছিল পাঁচটি মহকুমা, যথা—উত্তর শ্রীহট্ট (সিলেট), করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ, দক্ষিণ শ্রীহট্ট (মৌলভীবাজার) ও সুনামগঞ্জ।

ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের ভাগ হলেও সিলেট জেলা ভারতে নাকি পাকিস্তানে থাকবে, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হয়। এটিই ‘সিলেটের রেফারেন্ডাম’ বা ‘সিলেটের গণভোট’ নামে পরিচিতি পায়। নির্বাচনে কংগ্রেস ‘কুঁড়েঘর’ প্রতীক নিয়ে ভারতের পক্ষে এবং মুসলিম লীগ ‘কুড়াল’ প্রতীক নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিল। রেফারেন্ডাম কমিশনার হিসেবে ব্রিটিশ আমলা এইচ সি স্টর্ককে নিযুক্ত করা হয়। নির্বাচনে ২৩৯টি কেন্দ্রে ৪৭৮ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং ১ হাজার ৪৩৪ জন পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। মোট ভোটার ছিলেন ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন।

স্লোগান-প্রচারণায় মুখর

মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পক্ষে ভোটারদের টানতে নানা স্লোগান দেওয়া হয়। মুসলিম লীগের কর্মী-সমর্থকেরা ‘আসামে আর থাকব না, গুলি খেয়ে মরব না’, ‘ভূতের ঘরে কুড়াল মারো, পাকিস্তান আজাদ করো’, ‘পাকিস্তানের পেট্রলে সারা দুনিয়ার গাড়ি চলে’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ইত্যাদি স্লোগান দিত। অন্যদিকে কংগ্রেস কর্মীরা দিত ‘পাটের দেশে যাব না, ভাতের মাড় খাব না, অনাহারে মরব না’, ‘ঘরের লাগা শিলং শিলচর, আপনজনও তোর হইবে পর রে’, ‘সুখে যদি থাকতে চাও, ঘরের বাক্সে ভোট দাও’সহ নানা স্লোগান। দুই পক্ষই বিভিন্ন প্রচারপুস্তিকা প্রকাশ করে। পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য গান-কবিতা রচিত হয়। প্রচারণায় মুখর হয় শহর-গ্রাম।

মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন কর্মী শাহেদ আলী মুসলিম লীগের পক্ষে গণসংযোগে অংশ নিয়েছিলেন। পরে ১৯৫৪ সালে তিনি খেলাফতে রব্বানী পার্টির প্রার্থী হিসেবে সুনামগঞ্জ থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শাহেদ আলী (১৯২৫-২০০১) তাঁর আত্মজীবনী জীবনকথা (২০১৯) বইয়ে লিখেছেন, ‘রেফারেন্ডামের ডাকে কেবল সারা সিলেট নয়, পুরা আসাম ও বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গেল। বাংলাদেশে হাজার-হাজার মুসলিম লীগ-কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজের ছাত্র মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য ছড়িয়ে পড়ল সারা সিলেট। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকেও এল বহু নেতা ও কর্মী। [...] দেশজুড়ে এক মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লব ঘটে গেছে। এ এক ভাবাবেগের বন্যায় দেশের মানুষ ভাসছে। তাহলে এদের ঠেকাবে কে?’

মূলত হিন্দুধর্মাবলম্বী নেতারা কংগ্রেসের পক্ষে এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী নেতারা মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেন। তবে দলিত-তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু নেতা গণভোটে মুসলিম লীগের পক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিল কংগ্রেসঘেঁষা। বামপন্থী রাজনীতিবিদ প্রসূনকান্তি রায় (বরুণ রায়) তাঁর আত্মজীবনী সংগ্রামী স্মৃতির মোহনায় (২০১০) লিখেছেন, ‘উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দ্বন্দ্বের কারণে কংগ্রেসে সব সময়ই উচ্চবর্ণের নেতৃত্বে চলে। হিন্দু সমাজের দলিত বা অচ্যুত বা শিডিউল কাস্টের নেতা যোগেন্দ্র মণ্ডল মুসলিম লীগের সমর্থনে কাজ করার ফলে সিলেটে বসবাসরত নিম্নবর্ণের ভোট মুসলিম লীগে চলে যায়।’

গবেষক আলতাফ পারভেজ তাঁর যোগেন মণ্ডলের বহুজনবাদ ও দেশভাগ (২০১৯) বইয়ে লিখেছেন, ‘ইতিহাসের বড় কৌতুক এই যে যোগেন মণ্ডল যখন সিলেটের পূর্ব পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন তখন প্রভাবশালী মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানী (জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর নেতা) সিলেটের আসামভুক্তি তথা ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন।’

বঙ্গবন্ধুও এসেছিলেন

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে মুসলিম লীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে হাজার হাজার কর্মী সিলেটে এসেছিলেন। সদলবল তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও আসেন। সেটাই শেখ মুজিবের প্রথম সিলেট সফর। সে সময়কার সফরের বর্ণনা তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন এভাবে, ‘আমরা যখন সিলেটে পৌঁছালাম এবং কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, তখন শহীদ সাহেব সিলেটে আসেন। আমার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় করিমগঞ্জ মহকুমায় এক বিরাট জনসভায়। আমিও সেই সভায় বক্তৃতা করেছিলাম।’

বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘মওলানা তর্কবাগীশ, মানিক ভাই (ইত্তেফাক–এর সম্পাদক), ফজলুল হক ও আমি পাঁচশত কর্মী নিয়ে একদিন সিলেটে পৌঁছি। আমাদের জন্য সিলেটের গণভোট কমিটির কিছুই করতে হয় নাই—শুধু কোন এলাকায় কাজ করতে হবে, আমাদের সেখানে পৌঁছিয়ে দিতে হয়েছে। যাবতীয় খরচপত্রের ব্যবস্থা শহীদ সাহেব করে দিয়েছিলেন।’

স্মৃতিতে, শ্রুতিতে

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত (১৯৩৪) গণভোটের সময় কিশোর ছিলেন। তাঁর বাবা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ছিলেন তৎকালীন নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠিত সিলেট মুসলিম লীগ গণভোট বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর মা সৈয়দা সাহার বানু চৌধুরীও মুসলিম লীগের নারীনেত্রী ছিলেন। সে সময়কার স্মৃতি মুহিত তাঁর আত্মজীবনী সোনালি দিনগুলি (২০১৬) বইয়ে লিখেছেন এভাবে, ‘১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সিদ্ধান্তের পর আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হই এবং সেই উপলক্ষেই হয় আমার জীবনে জনসভায় প্রথম বক্তৃতা। ... আমাদের ধোপাদিঘির পাড়ের বাড়িতে স্থাপিত হয় ভোটার লিস্টের অতিরিক্ত কপি বানানো এবং ভোটের জন্য ভোটার স্লিপ তৈরি করা।’

ভাষাসংগ্রামী মো. আবদুল আজিজ (১৯৩৬) গণভোটে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনী কালের যাত্রার ধ্বনি (২০০৮) বইয়ে জানিয়েছেন, নির্বাচনের দুই দিন মুষলধারে শুরু হওয়া বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি হয়েছিল। ভোটের আগে সিলেটের গোয়ালাবাজারে অনুষ্ঠিত এক জনসভার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এ সভায় এসেছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বক্তৃতা করেন।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (১৯৩১-২০১৬) তখন নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তিনি সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় প্রায় এক মাস নৌকাযোগে মুসলিম লীগের পক্ষে গণসংযোগ করেন। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আত্মকথায় (২০১০) ছদরুদ্দিন লিখেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান পরিবারে গিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে “হ্যাঁ” (অর্থাৎ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হতে চাই) ভোট দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই।’

ফলাফল ও দেশত্যাগ

গণভোটের ফলাফল ১২ জুলাই দিল্লি পাঠানোর পর ১৮ জুলাই ভারত স্বাধীনতা আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী বিষয়টির বৈধতা দেওয়া হয়। পাকিস্তানে থাকার জন্য কুড়াল প্রতীকে ভোট পড়ে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯টি। অন্যদিকে আসামে থাকার জন্য কুঁড়েঘর প্রতীকে ভোট পড়েছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১টি। পাকিস্তানে থাকার পক্ষে ভোট বেশি পড়ে ৫৫ হাজার ৫৭৮টি। ফলাফল ঘোষণার পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো ঘটনা সিলেটে ঘটেনি। গণভোটে সিলেট পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৮ আগস্ট র‌্যাডলিফ সীমানা কমিশনের বিতর্কিত এক মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি থানাসহ করিমগঞ্জ মহকুমা আসামভুক্ত করা হয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আক্ষেপ অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়, ‘সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না। আমার বেশি দুঃখ হয়েছিল করিমগঞ্জ নিয়ে। কারণ, করিমগঞ্জে আমি কাজ করেছিলাম গণভোটের সময়।’

গণভোটের ফলাফলের পর সিলেটের উদ্বিগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারত যান। আসাম তথা করিমগঞ্জ থেকেও অনেক মুসলিম পরিবার সিলেটে আসেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী সুহাসিনী দাস সেকালের সিলেট (২০০৫) বইয়ে লিখেছেন, ‘চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি ছাড়তে হিন্দুরা দ্বিধাবোধ করেনি। তদ্রূপ আসাম থেকে দু–চার মুসলমান পরিবারও পূর্ব বাংলায় আসতে থাকে। স্বপল্লী ছাড়ার বেদনা ও মর্মপীড়া ভুক্তভোগীরাই বুঝেছিল। ... স্বাধীনতার পরিণতি যে এই হবে, তা আমরা কখনো চিন্তা করিনি।’

ইতিহাসবিদ সুজিৎ চৌধুরী (১৯৩৭-২০০৯) পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিলেট ছেড়ে করিমগঞ্জে চলে গিয়েছিলেন। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ হারানো দিন হারানো মানুষ–এ (২০০৫) তিনি লিখেছেন, ‘বাস ছাড়ল, সুরমার ব্রিজ পার হল, গ্রামের পথ ধরল। গোলাপগঞ্জে একটু থেমে শেওলায় পৌঁছোল দু-ঘণ্টায়। সেখানে কুশিয়ারা নদীর পারে কাস্টমসের চেকপোস্ট। বাক্সপ্যাঁটরা সব খুলে দেখাতে হল। ... নদী পেরোলাম জুড়িন্দা নৌকোয়। ওপারে ওই বাসেই চাপলাম। বাবা বললেন একটু পরে পাকিস্তান-সীমান্ত পেরিয়ে যাব।’

আলতাফ পারভেজ তাঁর যোগেন মণ্ডলের বহুজনবাদ ও দেশভাগ বইয়ে জানিয়েছেন, ‘গণভোট শেষে সিলেটে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়নি। পরবর্তী সময়ে যদিও অনেক হিন্দু পরিবার সিলেট ছেড়েছিল, কিন্তু এমন উদাহরণও বিপুল যে প্রগতিশীল হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং মাতৃভূমিতে থেকে যাওয়ার প্রশ্নে দৃঢ় ছিলেন এবং এ বিষয়ে সিলেটজুড়ে প্রচার আন্দোলন চালিয়েছিলেন।’

শিক্ষাবিদ বারীন্দ্রকুমার দাশ তাঁর আত্মজীবনী উজান-ভাটি: এক শিক্ষকের আত্মস্মৃতি (২০১৩) বইয়ে লিখেছেন, ‘দেশভাগের বেশ কিছুদিন পর আবার স্কুলে গেলাম। তখন মাস্টার মহাশয় আমাদের ডেকে কাছে নিয়ে নতুন করে সিলেটের মানচিত্র এঁকে দেখালেন। সেখানে বাদ পড়েছে করিমগঞ্জ মহকুমা। পাল্টে গেল সিলেটের মানচিত্র। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম সেই মানচিত্রের দিকে। মনে হলো নিজের শরীরের একটি অঙ্গ বুঝি খসে পড়েছে! অজ্ঞাতসারেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। না জানি কী হবে এর পরিণতি!’

যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের হাহাকার

প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭) সাম্প্রদায়িক চরিত্রের ভিত্তিতে দেশভাগের পক্ষে ছিলেন না। তাঁর আত্মজীবনী উজান গাঙ বাইয়া-তে (২০১২, শতবর্ষ সংস্করণ) লিখেছেন, ‘সিলেট আসামে থাকবে, না পূর্ব পাকিস্তানে যাবে তাই নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা এক গণভোটের আয়োজন করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ফাঁস করে দিয়ে জনগণকে বুঝিয়ে বলার বদলে পার্টি-নেতৃত্ব সিলেটের আসাম-ভুক্তির সপক্ষে নেমে পড়লেন। ... এই সুবিধাবাদী পার্টি-নীতির অনুগামী হয়ে আমিও গান লিখলাম: “ভাঙনের স্রোতে ভাঙিতে চাও কি সোনার সুর্মা ভূমি/ স্বদেশদরদী হিন্দু-মুসলমান জাগো জাগো আজ তুমি।” এ গানের কথা বা সুর কিছুই আমার ভালো মনে নেই। তবে শ্রীচৈতন্য, শাহজালাল প্রভৃতির প্রসঙ্গ এনে সিলেটের ধর্মীয় মিলনের আহ্বান ছিল, এটুকু মনে আছে।’

হেমাঙ্গ বিশ্বাস যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর অবস্থান ছিল সিলেটের আসামভুক্তির পক্ষে। কিন্তু দেশভাগের পর যখন তিনিও স্থায়ীভাবে কলকাতাবাসী হন, তখন তাঁর গান আর সুরে ঝরে যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের আর্তনাদ। বিষাদ ও হাহাকার মাখানো পঙ্‌ক্তিতে লেখেন, ‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর/ সুনামগঞ্জের কুড়া/ সুরমা নদীর গাংচিল আমি/ শূন্যে দিলাম উড়া ॥/ শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই, যাইতে চান্দের চর/ ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কৈল্কাত্তার উপর।/ তোমরা আমায় চিনছনি ॥/ হাওরের পানি নাইরে হেথায়, নাইরে তাজা মাছ/ বিলের বুকে ডালা মেলা, নাইরে হিজল গাছ/ বন্ধু নাইরে তাজা মাছ।/ তবু নিদহারা নগরের পথে রাইতের দুপুরে/ মরমিয়া ভাটিয়ালি আমার গলায় ঝুরে/ তোমরা আমায় চিনছনি ॥’

এ গান জন্মভূমির প্রতি স্মৃতিবিধুরতার অনুপম প্রকাশ আর দেশভাগের করুণ সত্যকেও ধারণ করেছে। বাস্তুচ্যুত চেনা-অচেনা মানুষের চোখের জলে যেন গানটি লেখা। আত্মপরিচয়–সংকটে ভুগে অপরিচিত পরিবেশে নিজের অসহায়তার ছবি স্পষ্ট করে আঁকেন হেমাঙ্গ এবং শূন্যে প্রশ্ন ছোড়েন—‘তোমরা আমায় চিনছনি’?