ঢাকা ও ঢাকার আশপাশ এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার একটি বড় কারণ দূষিত পানি। ওয়াসার পানি নিরাপদ নয়, এমন বক্তব্য অনেকেরই। তবে সবচেয়ে দূষিত পানি ঢাকার মানুষ পান করছেন কি না, সেই গবেষণার তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
অতিসম্প্রতি দূষণ বিষয়ে দুটি প্রতিবেদন দেশের মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। একটি প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ ঢাকা শহরে। আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, বায়ুদূষণে বিশ্বের সব নগরকে পেছনে ফেলেছে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শহরে বায়ুদূষণ বেশি, সেসব শহরে অপরাধ বেশি। দূষিত বায়ু মানুষকে অনৈতিক কাজে প্ররোচিত করে।
বায়ু, পানি ও শব্দদূষণ ঢাকার অপরাধ পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলেছে কি না, তা গবেষণার বিষয়। এ কথা ঠিক, যেকোনো দূষণের পেছনে কিছু অপরাধ থাকে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে ব্যক্তি ও ব্যক্তিচালিত প্রতিষ্ঠান।
দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন অপরাধ করে বা অনৈতিক আচরণ করে, তখন দূষণ বেড়ে যায়। তবে বায়ুদূষণের কারণে অপরাধ বা অনৈতিক আচরণ বৃদ্ধি পায়—এমন আলোচনা শুনতে পাওয়া যায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন গবেষক এমন দাবি করছেন যে বায়ুদূষণের কারণে অপরাধ বাড়ে, মানুষ অনৈতিক আচরণ বেশি করে।
গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের ৯ হাজার ৩৬০টি শহরের বায়ুদূষণের এবং অপরাধের ৯ বছরের তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনা করেছেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এসব শহরের বায়ুর কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড ও অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পদার্থের তথ্য–উপাত্ত তাঁরা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে। অপরাধের তথ্য তাঁরা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) ইউনিফর্ম ক্রাইম রিপোর্টিং প্রোগ্রাম থেকে। পর্যালোচনার জন্য তাঁরা সাত ধরনের অপরাধকে বেছে নেন—খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, গুরুতর আঘাত, সিঁদেল চুরি, সাধারণ চুরি ও মোটরযান চুরি।
তথ্য পর্যালোচনার সময় গবেষকেরা প্রতিটি শহরের জনসংখ্যা, মাথাপিছু গড় আয়, দারিদ্র্য, নারী–পুরুষের বেকারত্ব, শহরের মানুষের গড় বয়স, নারী–পুরুষের অনুপাত, শিক্ষা, নগরায়ণ, শিল্পায়ন কর্মকাণ্ড—এই সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছিলেন। পরে গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল বিশ্লেষণের সময় গবেষকেরা সাধারণ চুরির বিষয়টি বাদ দেন।
যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলেন, সাধারণ চুরির ঘটনা মানুষ আমলে কম নেয়, পুলিশকে কম অবহিত করে। চুরির ক্ষয়ক্ষতি বেশি না হলে তা নিয়ে কেউ অভিযোগ করে না।
ওই ৯ হাজার ৩৬০টি শহরের বায়ুদূষণ ও অপরাধের তথ্য পর্যালোচনা করে গবেষকেরা দেখেছেন, বায়ুদূষণ বেড়ে গেলে শহরে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।
বায়ুদূষণের সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক বিষয়ে আরও জানার চেষ্টা করেছিলেন গবেষকেরা। এই পর্যায়ে তাঁরা ২৫৬ জন (৫৪ শতাংশ নারী, গড় বয়স ৩৬ বছর) মানুষের ওপর পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা করেন। ওই গবেষণায় তাঁরা দেখতে পান, দূষিত বায়ুতে থাকা মানুষের প্রতারণার করার প্রবণতা নির্মল বায়ুতে থাকা মানুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
কেন এমন হয়? দূষিত বায়ু কেন মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়? দূষিত বায়ুতে কেন মানুষ অনৈতিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়? নাকি মানুষ বাধ্য হয়। এসব প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন গবেষকেরা। এই পর্যায়ে তাঁরা আরও দুটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা করেন। দুটিই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে।
গবেষকেরা পরিশেষে বলছেন, পরিবেশ বিপর্যয় বা বায়ুদূষণ মানুষের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়। উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তাবোধ কাজ করে। অনেকের অনৈতিক আচরণের গতি পরিবর্তন হয়।
গবেষণা প্রবন্ধটি ২০১৮ সালে অ্যাসোসিয়েশন ফর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘পলিউটেড মোরালিটি: এয়ার পলিউশন প্রেডিক্টস ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি অ্যান্ড আনইথিক্যাল বিহেভিয়ার’। এই গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে পরিবেশবিদ্যা, সমাজ–প্রতিবেশ মনোবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান ও নৈতিকতা মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে।