দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীরাই মুখ্য

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। পাশে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মেদ। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে। প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। পাশে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মেদ। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে।  প্রথম আলো

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন আঘাত হানছে। দিনে দিনে এর তীব্রতা বাড়ছে। নারী ও শিশুরাই দুর্যোগের মূল ভুক্তভোগী। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজে নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

গতকাল শনিবার সকালে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘জলবায়ু সহনশীলতায় গ্রামীণ নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো

আলোচকেরা বলেন, দুর্যোগ শুরুর আগে থেকেই নারীকে ব্যবস্থাপনার কাজে নামতে হয়। ঘরের জিনিসপত্র ও খাবার সংরক্ষণ, গবাদিপশু সামলানো, পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের দেখভাল, সন্তান নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়াসহ নারীর অনেক দায়িত্ব। আবার দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ, রান্না করাসহ বেশির ভাগ কাজের দায়িত্ব নারীকেই নিতে হয়। এসব কাজে নারীর সক্ষমতা আরও বাড়ানো গেলে অর্থনৈতিক ও নারীর নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমে যাবে।

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল ডুবে যাবে না। তবে লবণাক্ততা বাড়ায় খাওয়ার পানি ও খাবার উৎপাদন নিয়ে সংকট তৈরি হবে। নারীকে এ কাজগুলো করতে হয় বলে তাঁদের নানা ধরনের ঝুঁকি বাড়বে।

একাধিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ে নিজের ও মায়ের অভিজ্ঞতার কথা শোনান পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সন্দ্বীপের ছেলে এ কে এম রফিক আহাম্মদ। তিনি বলেন, ২৫টি মন্ত্রণালয় থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করা হচ্ছে, আগের থেকে বাজেটও বাড়ছে। পাশাপাশি নারীদের প্রশিক্ষণসহ আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত আসা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীর সক্ষমতার স্বীকৃতি সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আসতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ কার্যকরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় নারী নাজুক নয় বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক মাহবুবা নাসরীন। কেবল জলবায়ু পরিবর্তন নয়, মানবসৃষ্ট কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে বলে উল্লেখ করেন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ফিলিপ গাইন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, শ্রমশক্তিতে জড়িত নারীদের ৬৫ শতাংশ গ্রামীণ নারী। কৃষিতেও তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এই তথ্য বিবেচনা করে জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দুর্যোগের সময় গ্রামীণ নারী ও সেবা প্রদানকারীদের সক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে দুই বছর ধরে কাজ করছে এমজেএফ। এ বিষয়টি উপস্থাপন করে এমজেএফের জেন্ডার অ্যাডভাইজার বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন, স্বাস্থ্যসমস্যা, খাবারের ঘাটতি ও নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে নারীদের ঝুঁকি বেশি।

গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জলবায়ুর পরিবর্তনবিষয়ক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে হবে বলে জানান সিডার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রোগ্রাম অ্যাডভাইজার মাহবুবুর রহমান।

ইউএনডিপির লোকাল গভর্মেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের কো-অর্ডিনেটর সেলিনা শেলী বলেন, দেশের প্রতিটি গ্রামের ধরন-প্রকৃতি আলাদা, প্রাকৃতিক দুর্যোগরোধে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু সহনশীলতা বাড়াতে হলে কোথায় কোন সম্পদ আছে, নারীর জন্য কীভাবে এর ব্যবহার করা যায়, তা দেখতে হবে।

পরিবেশগত ঝুঁকি ও নারীর ঝুঁকি সমান্তরালে চলে বলে উল্লেখ করেন ইউএন উইমেনের জেন্ডার মেইন স্ট্রিমিং অ্যানালিস্ট ফারহানা হাফিজ। সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের রিস্ক রিডাকশন অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর সৈয়দ মতিউল আহসান বলেন, পরিবেশের তারতম্যের কারণে কিশোরীদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা বাড়ে। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়।

এমজেএফের ক্লাইমেট চেঞ্জের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আহসানুল ওয়াহিদ বলেন, নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে খাসজমিতে তাঁদের অধিকার পাওয়ার বিষয়ে জোর দিতে হবে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।