এফএওর প্রতিবেদন

দুর্যোগেও চাল উৎপাদন বেশি, দাম কমছে না

ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশ এবারও বিশ্বের তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে।

সূত্র: এফএও
সূত্র: এফএও

গত বছর বর্ষার আগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তারপর চার দফা বন্যার আঘাত। আর এ বছর আরেক ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশের নাকের সামনে দিয়ে চলে গেলেও উপকূলজুড়ে রেখে গেছে ক্ষত। এত সব আঘাত আর বিপদের মুখেও দেশের কৃষকেরা আবারও চমকে দিয়েছেন বিশ্বকে। এবারও ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা কয়েকটি দুর্যোগ মোকাবিলা করেও বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টন চাল উৎপাদন করে। ওই বছর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে তৃতীয় স্থানে উঠে আসে। ২০২০ সালে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে বাংলাদেশ আবারও তৃতীয় স্থানে থাকে। উৎপাদিত হয় ৩ কোটি ৭৪ লাখ টন চাল। চলতি বছরও বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে থাকবে বলে এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন বেড়ে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টন হবে বলে সংস্থাটি মনে করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে আবারও তৃতীয় স্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। এ বছর তাদের মোট উৎপাদন ৬ শতাংশের বেশি বেড়ে ৩ কোটি ৭১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে।

চীন ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ও ভারত ১২ কোটি ৩১ লাখ টন চাল উৎপাদন করে এক ও দুই নম্বর অবস্থানে থাকবে বলে প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চীন, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ায় চালের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ভারতে বাড়ছে না।

খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আরও গুরুত্ব দিচ্ছি। বাজারে চালকলমালিকদের দৌরাত্ম্য কমাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান রাখার গুদাম নির্মাণ করছি। যেখানে কৃষক সরাসরি ধান বিক্রি করতে পারবে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেশে ধানের উৎপাদন আরও বাড়বে।’

এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চাল উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে এর বাড়তি দাম। সঙ্গে বেড়েছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার। চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে এ বছর চালের উৎপাদন বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

চালের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও দাম কিন্তু সে অনুপাতে কমছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চলতি বছর বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ছিল ৩৮ টাকা। আর সরকার প্রতি কেজি চাল ৪০ টাকা ও ধান ২৭ টাকা দরে কেনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বাজারে ধানের দাম সরকারের সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে চার–পাঁচ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। আর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার এই সুফল যাচ্ছে চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। কৃষকেরা সরকারঘোষিত ধানের দাম পাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিজেরা গবেষণা করে দেখেছি যে দেশের চালের বাজার হাতে গোনা কিছু চালকলমালিক নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা ধান কেনা, চাল প্রক্রিয়াজাত করা থেকে শুরু করে দেশের ভেতরে বাজারজাত করা নিয়ন্ত্রণ করেন। এমনকি চাল আমদানি-রপ্তানিও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে দেশে চালের উৎপাদন বেড়ে গেলে কৃষকদের চেয়ে ওই চালকলমালিক গোষ্ঠীর লাভ বেশি হয়।’

তবে বাংলাদেশে করোনার এই সময়ে চালের ভোগ বা চাহিদা বেড়ে গেছে। গত বছর বাংলাদেশ ১৮ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট দানাদার খাদ্য আমদানি হয়েছে ৯৮ লাখ টন। চালের পাশাপাশি গমের আমদানিও গত বছর ৪ লাখ টন বেড়ে ৬৪ লাখ টন হয়েছে। তবে চলতি বছর তা এক লাখ টন কমতে পারে। মূলত চালের উৎপাদন ভালো হলে গমের চাহিদা ও আমদানি কমে যায় বলে মনে করা হয়। গত এক যুগে দেশে গমের ভোগ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন ১০ লাখ টন থেকে বেশ কমে ৭ লাখ টনে নেমে আসে। গত বছর তা বেড়ে আবারও ১১ লাখ টন হয়েছে। চলতি বছর তা ১৩ লাখ টন হতে পারে।

কিছুটা কমতে পারে গরুর মাংসের উৎপাদন

অন্যদিকে ছয় বছর ধরে বাংলাদেশে গরুর মাংস ও গরু আমদানি প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে দেশে গরুর মাংস ও দুধের উৎপাদন বাড়ছিল। ২০২০ সালে দেশে গরুর মাংসের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টন। চলতি বছর তা কমে ২ লাখ ৩২ হাজার টন হতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

উৎপাদন কমার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে দেশের মানুষদের একটি বড় অংশের আয় কমে গেছে। ফলে তাঁদের অনেকেই গরু-খাসির মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক খামারি দাম কম হওয়ায় বিক্রিও কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে গরু-খাসির মাংসের বিক্রি কমেছে। কিন্তু দেশে সামগ্রিকভাবে গরু-ছাগলের উৎপাদন কমেনি, বরং বেড়েছে।

আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পুষ্টিকর খাবার যেমন ভোজ্যতেলের আমদানিও বেড়েছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ গড়ে ২৫ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করত। ২০২০ সালে তা কমে ২২ লাখ টনে নেমে আসে। চলতি বছর কিছুটা বেড়ে তা ২২ লাখ টন হতে পারে। এই ভোজ্যতেলের বড় অংশ আসে মালয়েশিয়া থেকে পাম ও সয়াবিন তেল হিসেবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সয়াবিন, সূর্যমুখী ও জলপাই বা অলিভ অয়েল আমদানি হয়। এই সব তেল আমদানি চলতি বছর বাড়তে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।