পুষ্টিবিদেরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবকালে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। অথচ দুগ্ধপণ্য বিপণনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, দেশে এখন দুধের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বরং কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ অনুযায়ী একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা উচিত। কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম দুধ পান করে বাংলাদেশের মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দেশের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ দুধ পান করে।
দেশে দুধ পান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে দৈনিক মাথাপিছু দুধ গ্রহণের পরিমাণ ১৬৫ মিলিলিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের পরিমাণ ২৭ গ্রামের কিছু বেশি। এটা আবার ২০১০ সালের তুলনায় কম। ওই বছর মাথাপিছু দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৩৪ গ্রামের কাছাকাছি। এর মানে হলো, আগে মানুষ গড়ে যে পরিমাণ দুধ গ্রহণ করত, সেটা কমেছে।
সত্যিকারের পরিস্থিতি কী, তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রায়হান হাবীব বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব নিয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। আমার বিশ্লেষণ হলো, দেশে মাথাপিছু দুধ গ্রহণ গড়ে দৈনিক ৮৮ মিলিলিটারের বেশি হবে না। যেটা প্রয়োজনের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ।’
এই রকমই এক পরিস্থিতিতে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। দুগ্ধ খাত–সম্পর্কিত কার্যক্রমে নজর বাড়াতে ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের পর্যাপ্ত দুধ না খাওয়া বা পাওয়ার প্রধান কারণ এখানে চাহিদার তুলনায় দুধের উৎপাদন কম। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে দুধের উৎপাদন ছিল ৯৯ লাখ মেট্রিক টন, যা দেশের মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশের মতো। আগের বছর উৎপাদন ছিল ৯৪ লাখ টন।
দেশে দুধের উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে জানায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলো। তাদের মতে, প্রথম কারণ দেশীয় গাভির উৎপাদনশীলতা কম। এ দেশে স্থানীয় জাতের গরু বেশি পালন করা হয়, যেগুলো দৈনিক মাত্র দুই থেকে আড়াই লিটার করে দুধ দেয়। এতে দুধ উৎপাদনে মানুষের খরচ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ, গাভি পালন কম। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় যেভাবে উন্নত জাতের গাভি পালন করে বাড়তি দুধ উৎপাদন করা হয়, অন্যান্য এলাকায় সেভাবে হয় না। তৃতীয়ত, নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতার অভাবও রয়েছে।
দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দেশে উন্নত জাতের গাভি পালন করতে হবে। এ জন্য উন্নত জাত আনতে হবে। গাভি পালনে উৎসাহ দিতে মানুষকে বোঝাতে হবে যে উন্নত জাতের গরু পালন একটি ভালো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে। তিনি মনে করেন, দেশে উৎপাদন বাড়াতে বিদেশি গুঁড়া দুধ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। কারণ, দুধের বাজারের একটি বড় হিস্যা গুঁড়া দুধের।
ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলো প্রতিদিন দেশের মোট উৎপাদিত দুধের মাত্র ৫ শতাংশ সংগ্রহ করে। এর পরিমাণ সাড়ে ১৩ লাখ লিটারের মতো।
দেশে মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনে (বিএসটিআই) নিবন্ধিত ১৪টি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে মিল্কভিটা নামে পরিচিত বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড বাজার হিস্যায় সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া প্রাণ ডেইরি, ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ বাজার হিস্যায় সামনের সারিতে রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরুর পর দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলে দুধের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। এখনো দুধের চাহিদা কম বলে জানান বিপণনকারীরা।
ব্র্যাক ডেইরির পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, সাধারণত পবিত্র রমজান মাসে তরল দুধের যে চাহিদা থাকে, এবার ছিল তার চেয়ে ৩০ শতাংশের মতো কম।
প্রাণের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা থাকলেও বিপণনজনিত সমস্যার কারণে দুধ পৌঁছানো যায়নি।
বিশ্বজুড়ে দুধ একটি স্বীকৃত পুষ্টিকর খাবার। এ কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মানুষকে নিয়মিত দুধ পান করার পরামর্শ দেয়। দুধে আছে ক্যালসিয়াম, যা হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য জরুরি। দুধের আমিষ শরীরে শক্তি জোগায়। দুধ মানুষের শরীরে পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন এ, জিংকসহ নানা ধরনের পুষ্টি উপাদানের জোগান দেয়।
করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিবিদেরা দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খালেদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা করোনাকালে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে আমিষজাতীয় খাবার খাওয়ার কথা বলছি। সে ক্ষেত্রে দুধ একটি ভালো উৎস। দুধের আরেকটি সুবিধা হলো এটি তরল। করোনাকালে তরল খাবার বেশি খেতে হয়। দুধ সহজলভ্যও।’
জাতিসংঘের ‘স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে একজন অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টির কারণে ৫ বছরের কম বয়সী ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বকায় (উচ্চতা কম) ও ৩৩ শতাংশ কৃশকায় (ওজন কম)।
সব মানুষের পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সব সময়ই দুধ পান করার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, ‘দুধ খুবই উপকারী। শুধু উচ্চ রক্তচাপের রোগী ও ওজন বেড়ে যাওয়া মানুষেরা দুধের সর খাবেন না। আর যাদের দুধ সহ্য হয় না, তারা পানি মিশিয়ে পাতলা করে খেতে পারেন।’