সংবাদ সম্মেলন করে দুদক জানায়, প্রভাবশালীদের চাপে নয়, চাকরিবিধি না মানার কারণে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে।
দুর্নীতির তদন্তে প্রভাবশালীদের নাম আসায় তাঁদের চাপে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয় বলে জানিয়েছেন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, চাকরিবিধি না মানার কারণে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে গতকাল রোববার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের সচিব এ কথা বলেন। তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কিছু মামলায় প্রভাবশালীদের নাম আসায় তাঁদের চাপে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে, এটা মোটেও সত্য নয়।
বিনা নোটিশে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা নিয়ে কয়েক দিন ধরে নানামুখী আলোচনার মধ্যে গতকাল আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় দুদক। শরীফকে কোন প্রেক্ষাপটে অপসারণ করতে হয়েছে, সে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ তুলে ধরে দুদক। তাতে দেখা যায়, সব অভিযোগই কক্সবাজার ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। এ অভিযোগগুলোর অধিকাংশই গত কয়েক দিনে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে এবং এসব অভিযোগের জবাবও দিয়েছেন শরীফ উদ্দিন।
দুদকের অভিযোগ, শরীফ উদ্দিন অনুসন্ধান ও তদন্তে নিজের খেয়ালখুশিমতো কার্য পরিচালনা করতেন, নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না। আদালতের অনুমতি ছাড়া লিখিত ও মৌখিকভাবে ৩৩টি ব্যাংক হিসাব তিনি জব্দ করেন, যা কমিশনকে বিব্রত করেছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে (ভূমি অধিগ্রহণ কাজে যুক্ত) এক সার্ভেয়ারের বাসা থেকে র্যাবের জব্দ করা ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে না রেখে এবং কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে এক বছর চার মাস নিজের হেফাজতে রাখা, অভিযোগসংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তিকে (সিআইপি মো. ইদ্রিস) জবানবন্দি গ্রহণের জন্য নিজ দপ্তরে ডেকে এনে নির্মমভাবে প্রহার করা, চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলির পরেও দীর্ঘদিন কর্মস্থলে না গিয়ে কমিশনের আদেশ অবজ্ঞা করা, বদলির আদেশের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীকে দিয়ে হাইকোর্টে রিট করানো এবং পত্রিকায় খবর ছাপানো, চট্টগ্রামের কর্মস্থল ত্যাগের সময় তাঁর দায়িত্বহীন অনুসন্ধান ও তদন্তের নথিপত্র বুঝিয়ে না দেওয়া, কক্সবাজার জেলার ভূমি অধিগ্রহণ–সংক্রান্ত মামলার তদন্তে কমিশনের বিধিমালা অনুসরণ না করা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) অনিয়ম তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে ছোট ভাই শিহাব উদ্দিনকে চাকরি দেওয়া, আরেক আত্মীয় শাহাব উদ্দিনকে জাল সনদের মাধ্যমে কেজিটিসিএলের চালকের পদে চাকরি দেওয়া। এ ছাড়া শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন ও অনুসন্ধানের নামে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নোটিশ দিয়ে ডেকে এনে হয়রানি করার অভিযোগ করেন সচিব।
লিখিত বক্তব্যে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, দু-তিন দিন ধরে বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া অপসারণকৃত উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের বিষয়ে বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করছে। তিনি বলেন, কেউ যদি কমিশনের নিয়ম, চাকরিবিধি, অফিস ব্যবস্থাপনা না মানেন; তাহলে ‘হার্ড লাইনে’ যেতেই হবে।
শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তার কোনোটি প্রমাণিত না। দুদক বলছে, চাকরিবিধি অনুযায়ী তিন বছর পর বদলি করা হয়; কিন্তু দুদকে এমন অনেক কর্মকর্তা আছেন, তিন বছরের বেশি সময় একই জায়গায় কাজ করছেন। তাহলে শরীফের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত কেন? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি দুদক সচিব।
আরেক প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, ‘দুদক একটি সংবিধিবদ্ধ আইনি প্রতিষ্ঠান। আমাদের তদন্ত অনুসন্ধান যাঁরা করে থাকেন, তাঁরা একটা সেট রুলস অনুসরণ করেন। আমাদের বিধানের প্রসিডিংস রয়েছে, আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। তিনি (শরীফ) একসঙ্গে ২৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লিখিতভাবে বন্ধ করে দিলেন, মৌখিকভাবে বন্ধ করে দিলেন ৮টি। আপনি যদি সার্ভিস করেন, তাহলে সার্ভিস রুল মানতে হবে। নিজের মনগড়া কাজ করতে পারবেন না।’
তাহলে এসিআরে (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) শরীফ উদ্দিনকে ‘অতি উত্তম’ বলা হয়েছিল কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সম্ভবত ২০১৪ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। সাধারণত নবীন যাঁরা যোগদান করেন, স্বভাবগত কারণে তাঁদের উৎসাহিত করার জন্য এবং তখন যেসব কাজকর্ম করেছেন, সেটির মূল্যায়ন করা হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আপনি আজ যে অবস্থানে আছেন, এক দিন পর, দুই দিন পর সে অবস্থানে থাকবেন কি না, তা আপনিও জানেন না। তাঁর সিকোয়েন্সিয়াল যে মূল্যায়ন, সেটা আমলে নিতে হবে। এটা চাকরির অংশ, শুধু ওই একটা দেখে, বাকি সব ওভারলুক (এড়িয়ে যাওয়ার) করার সুযোগ নেই।’
শরীফ উদ্দিনকে ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের চাকরিবিধির ৫৪(২) ধারা মোতাবেক অপসারণের আদেশ জারি করেন দুদক চেয়ারম্যান। এর প্রতিবাদে পরদিন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানববন্ধন করেন। এর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে শরীফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে চাকরিচ্যুতির পেছনে ‘পর্দার আড়ালের শক্তি’ কাজ করেছে।
শরীফ উদ্দিনের জীবনের নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় আদেশের আরজি নিয়ে চিঠি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে গতকাল এই চিঠি দেন তাঁরা।
এতে হাইকোর্ট রুলসের (সংশোধিত) বিধি অনুসারে চিঠিটি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আবেদন (রিট) হিসেবে বিবেচনার আরজিও রয়েছে।
এই ১০ আইনজীবীর একজন শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে। ২০১২ সালের সংশোধিত হাইকোর্ট রুলসের ১১ক অধ্যায়ের ১০ বিধি অনুযায়ী চিঠিটি পাঠানো হয়। প্রক্রিয়া অনুসারে আদালত চিঠিটি আবেদন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে শুনানি করতে পারেন।
চিঠিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন পড়ে তাঁদের মনে হয়েছে, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং এতে জড়িত রয়েছে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মারাত্মক অন্যায় ও অসংগতি। এ ধরনের ঘটনা বর্তমান সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পথে অন্তরায়। এতে দুর্নীতি প্রতিরোধে গৃহীত বহুমুখী পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়বে।