মো. শরীফ উদ্দিন
মো. শরীফ উদ্দিন

চাকরি হারানো দুদক কর্মকর্তা

দুদকের কাছেই তিনি ছিলেন ‘অতি উত্তম’

কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়মের ঘটনা নিয়ে তদন্ত করার পর দুদকের কাছে শরীফ উদ্দিন হয়ে যান ‘চলতি মানের’ কর্মকর্তা।

  • ২০১৭ সালে শরীফ উদ্দিনকে ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তা বলেছিলেন দুদকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

  • ২০১৯ সাল তাঁকে ‘উদ্যমী ও দক্ষ’ কর্মকর্তা বলা হয়েছিল।

মাত্র সাড়ে সাত বছরের চাকরিজীবনের প্রথম ছয় বছরই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন ছিলেন ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তা। তাঁকে তদন্তকাজে ‘অভিজ্ঞ’ এবং ‘উদ্যমী ও দক্ষ কর্মকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে দুদক। বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) শরীফ সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন করেছেন দুদকেরই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

তবে কক্সবাজারে তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়মের ঘটনার তদন্তে সরকারি কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজনের জড়িত থাকার বিষয়টি শরীফ তুলে ধরার পর এসিআরে তাঁর সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মনোভাবও পাল্টে যায়। ‘অতি উত্তম’ থেকে শরীফ হয়ে যান ‘চলতি মানের’ কর্মকর্তা। সর্বশেষ ২০২০ সালের মূল্যায়নে তাঁর এসিআর প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘ঔদ্ধত্যের প্রবণতা রয়েছে’। শরীফ সম্পর্কে আরও লেখা হয় ‘ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে অনীহা’।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার শাহাপুর হাজি বাড়ির মৃত ফজর আলীর ছেলে শরীফ উদ্দিন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে দুদকের উপসহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর। প্রথম তিন বছর দুদকের ময়মনসিংহ কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর তাঁকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। চট্টগ্রামে থাকার সময় তিনি দুর্নীতির ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পৃথকভাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম), চট্টগ্রাম জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের জিএম, সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নূরুল ইসলামের ছেলেসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এসব কারণেও প্রভাবশালীরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করতেও সফল হন তাঁরা।

চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত বছরের ৩০ জুন শরীফকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। আর চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ কোনো কারণ উল্লেখ না করেই তাঁকে চাকরিচ্যুত করে দুদক।

‘অতি উত্তম’ থেকে ‘চলতি মান’

দুদক সূত্র জানায়, ২০২০ সালের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে শরীফ সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন (দুদক চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো) কর্মকর্তারা বিরূপ মন্তব্য (ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে অনীহা) করেছিলেন। এমন মন্তব্য করার কারণ জানতে চেয়ে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সংস্থার চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তৎকালীন উপপরিচালক মাহবুবুল আলমকে চিঠি দিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়, গোপনীয় প্রতিবেদনে যে মন্তব্য করা হয়েছে, সে বিষয়ে শরীফকে লিখিত বা মৌখিকভাবে সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল কি না।

মাহবুবুল আলম বর্তমানে ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। একজন ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তার মধ্যে হঠাৎ করে কেন ঔদ্ধত্যের প্রবণতা দেখা দিল, এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। পরে দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বর্তমান পরিচালক মাহমুদ হাসানের কাছে একই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যিনি মন্তব্য লিখেছিলেন, তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’

চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিন গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের নিয়ম অনুযায়ী কারও এসিআরে বিরূপ মন্তব্য লেখা হলে তাঁর কাছে কারণ ব্যাখ্যা চাইতে হয়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এটি মানা হয়নি। কোনো কৈফিয়ত না চেয়ে তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়। তিনি বলেন, গত বছরের ২১ নভেম্বর তাঁর ব্যাচের ২৯ জনের পদোন্নতি হয়। কিন্তু তিনি বঞ্চিত থাকেন। শুধু দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস না করায় তাঁর এ দশা।

যদিও ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই এসিআরে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শরীফ উদ্দিনকে ‘পদোন্নতির যোগ্য’ কর্মকর্তা বলে উল্লেখ করেছিলেন। এমনকি ২০২০ সালে তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মূল্যায়ন করা হলেও তিনি ‘পদোন্নতির যোগ্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে তাঁর পদোন্নতি হয়নি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে তাঁকে কাজের ক্ষেত্রে ‘উওম’ বলা হয়েছিল এসিআরে। ২০১৭ থেকে তাঁকে ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তা বলা হয়েছিল। আর ২০১৯ সাল তাঁকে একজন ‘উদ্যমী ও দক্ষ’ কর্মকর্তা বলা হয়।

বদলির পর মামলার কার্যক্রমে ধীরগতি

চট্টগ্রামে সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালনের সময় দুর্নীতির মোট ৩০টি মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। এর মধ্যে অভিযোগপত্র দেন ১৫টির। অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ করেন আরও ২২টির। বদলির আগ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দুর্নীতির মোট ৪৫টি মামলার তদন্ত করছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে তাঁকে বদলি করার পর এসব মামলার তদন্ত চলছে ধীরগতিতে।

‘খালাসি’ পদে ১৯ জনকে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে গত বছরের ৩১ মার্চ রেলেওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন শরীফ। এ মামলায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি।

ভোটার তালিকা প্রণয়নে ব্যবহৃত ল্যাপটপ আত্মসাৎ, ৫৫ হাজার ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ভোটার করার (যাঁদের মধ্যে রোহিঙ্গারাও রয়েছে) অভিযোগে গত বছরের ১৬ জুন দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ে একটি মামলা করেন শরীফ উদ্দিন। এ মামলা চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ল্যাপটপ আত্মসাৎ ও অবৈধ ভোটার অন্তর্ভুক্তি ঘটনা ঘটে। কিন্তু গত বছরের জুনে শরীফকে বদলির পর অগ্রগতি নেই এ মামলায়।

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতার অভিযোগে গত বছরের ২১ জুন তিন পুলিশ পরিদর্শক, একজন নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেছিলেন শরীফ। তিন পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনার সময় কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। এ মামলার কার্যক্রমও এখন থেমে আছে। আসামিদের কেউ গ্রেপ্তার হননি।

দুদকের করা বিভিন্ন মামলায় নতুন করে আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া এবং তদন্তে ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রামের পরিচালক মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন তদন্ত কর্মকর্তারা মামলার নথি বুঝে নিয়েছেন। তাঁরা কাজ করছেন। অগ্রগতি থাকবে সামনে।

এ ছাড়া গত বছরের ১০ জুন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ। এ মামলায় মন্ত্রীপুত্রসহ দুজন ছাড়া বাকি তিনজনকে গ্রেপ্তার হন। এরপর মামলাটির কার্যক্রম আর এগোচ্ছে না।

সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দুদকের করা মামলার তদন্ত শেষ করা উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি এখনই বন্ধ করা উচিত। এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। শরীফের মতো যেসব কর্মকর্তা এসব ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনে কাজ করেছেন, তাঁদের দূরে সরিয়ে দিতে সব সময় চেষ্টা করবে প্রভাবশালী পক্ষটি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।