শহরের নানুয়া দীঘির পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি শনাক্ত।
ঘটনার পর থেকেই চারটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রথমত অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন কে বা কারা নিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন কোন ব্যক্তি। তৃতীয়ত, ঘটনাটি ফেসবুকে প্রথম লাইভ (প্রচার) কে করেছিলেন। চতুর্থত, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও হামলার পেছনে সংগঠিত কোনো শক্তি কাজ করেছে কি না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর জানা গেছে। প্রথম ও চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর জানার কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে দুর্গাপূজা উপলক্ষে অস্থায়ীভাবে করা একটি পূজামণ্ডপ থেকেই ঘটনার শুরু। এই পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে কুমিল্লা শহরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। এর জের ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, ফেনী এবং রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মন্দির-মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুরের পাশাপাশি আক্রমণের শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পীরগঞ্জে পুড়িয়ে দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি।
যেদিন সকালে (১৩ অক্টোবর) ঘটনার সূত্রপাত, তার আগের দিন রাত দুইটা পর্যন্ত নানুয়া দীঘির পাড়ের ওই অস্থায়ী মণ্ডপে পূজা অর্চনা চলে। পুলিশ সূত্র জানায়, ১৩ অক্টোবর সকাল সাতটার দিকে একরাম হোসেন নামের স্থানীয় এক যুবক ৯৯৯ জরুরি সেবায় ফোন দিয়ে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ থাকার তথ্য জানান। এতে বোঝা যায়, পবিত্র কোরআন শরিফ রাখা হয়েছে ১২ অক্টোবর দিবাগত রাত ২টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে।
এখন পর্যন্ত পুলিশের তদন্ত বলছে, পবিত্র কোরআন শরিফ মণ্ডপে যে ব্যক্তি নিয়ে যান, তাঁর বয়স ৩৫–এর কাছাকাছি। কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘি এলাকাতেই তাঁর বাড়ি। সন্দেহভাজন এই ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ রাখছে। তবে এখনো তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
ওই ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের? এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, গ্রেপ্তারের আগে ওই ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় তাঁরা প্রকাশ করতে চাইছেন না।
কীভাবে ওই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, এমন প্রশ্নে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, আশপাশের বাড়ির সিসি ক্যামেরা এবং বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে তাঁরা ওই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছেন। তবে এখন তাঁর অবস্থান কোথায়, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাঁকে না ধরা পর্যন্ত ঘটনার পেছনের কারণ জানা সম্ভব নয়।
কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মূল অভিযুক্ত বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকে আমরা ধরে ফেলতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস।’
পুলিশ সূত্র জানায়, কুমিল্লার মণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার বিষয়টি জানিয়ে জরুরি সেবায় ফোন করেছিলেন একরাম হোসেন নামের স্থানীয় এক যুবক। পুলিশ সূত্র বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে একরামকে। তিনি ঘটনাচক্রে সেখানে ছিলেন বলেই এখন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে। জরুরি সেবায় একরাম হোসেনের ফোন পেয়ে সাদাপোশাকেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম। সেখানে গিয়ে তিনি পবিত্র কোরআন শরিফ উদ্ধার করেন। উপস্থিত মানুষের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। ওই সময় মোহাম্মদ ফয়েজ নামের এক ব্যক্তি ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ করতে থাকেন। তিনি লাইভে পবিত্র কোরআন অবমাননার কথা উল্লেখ করে মানুষকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্ররোচনা দেন। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে মানুষ জমায়েত হতে থাকে। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। ফয়েজের লাইভ করার উদ্দেশ্য নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় লোকজন।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বিষয়টি ফেসবুকে লাইভ করেছেন বলে ফয়েজ পুলিশকে জানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে অন্য কারও যোগাযোগ ছিল কি না, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের মাধ্যমে গতকাল দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্র ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ফয়েজ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আগে আগে দেশে আসেন। কুমিল্লার কান্দিরপাড় খন্দকার হক ম্যানশনে মোবাইল ফোনের দোকান দিয়েছেন এখন। থাকেন নানুয়া দীঘির পাড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে দিগাম্বরী তলায়।
ফয়েজের সঙ্গে ব্যবসা করা খন্দকার মার্কেটের এক দোকানি বলেন, ফয়েজের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি কখনো শোনা যায়নি।
সম্প্রীতির গল্প ছাপিয়ে উত্তেজনা
প্রায় পৌনে ছয় শ বছরের পুরোনো নানুয়া দীঘির আশপাশে দীর্ঘকাল থেকেই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বসবাস। দিন দিন সেখানে মুসলমানদের বসতি বেড়েছে। তবে এখনো দীঘির আশপাশের বাসিন্দাদের ৪০ শতাংশ হিন্দুধর্মাবলম্বী।
নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির প্রয়াত নেতা আকবর হোসেনের বাড়ি। ওই বাড়ির সামনেই অস্থায়ী পূজামণ্ডপটির অবস্থান ছিল। দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হকের বাড়ি। এলাকাটি একসময় কুমিল্লা শহরের অভিজাত এলাকা ছিল।
ঘটনার পর থেকে স্থানীয় মানুষের মনে নানা প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রীতির শহরে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল, তা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না স্থানীয় লোকজন।
কুমিল্লার স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ও বিভিন্ন দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতে দেশে যেসব সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, এর মূল ভূমিকায় ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠীকে দেখা গেছে। এবার নেতৃত্বে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দেখা যায়নি।
নানুয়া দীঘির পাড়ের বিক্ষোভ ও মন্দিরে হামলাকারীদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। পোশাক-আশাকও সাধারণ।
পুলিশের সূত্র বলছে, মণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ উদ্ধার এবং ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ করার পরই কম বয়সী ছেলেরা জমায়েত হতে থাকে। তবে শুরুতে জমায়েত হওয়াদের বেশির ভাগের দাবি ছিল, নানুয়া দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপ বন্ধ করে দিতে হবে। দু-একজন মণ্ডপ ভেঙে ফেলার দাবি তুললে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে।
নানুয়া দীঘির পাড়ের কাছেই থাকেন কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহসানুল কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমন অশান্তি গত ৫০ বছরে দেখেননি। সেদিন বিক্ষোভ করতে আসা লোকজনের বেশির ভাগই ছিল বয়সে তরুণ, অচেনা। তাদের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী, বোঝা যাচ্ছিল না। একেকজন একেক দাবি করছিল। তাদের শান্ত করতে আশপাশের মসজিদের মাইকে আহ্বান জানানো হয়। এরপরও কীভাবে যেন তা পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা
পুলিশ সূত্র বলছে, নানুয়া দীঘির পাড়ে দিনভর উত্তেজনায় একসঙ্গে ৫০০ মানুষের বেশি উপস্থিত ছিল না। শহরের বিভিন্ন স্থানে যেসব মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে, তাতে বেশি মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না। তাদের ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যাপ্ত কঠোর অবস্থান নেয়নি। নানুয়া দীঘির পাড়ে ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ৩০০-৪০০ মানুষ বিক্ষোভ করছিল। এ সময় সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত হয়ে মাইকে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। একদিকে বিক্ষোভ, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবস্থান—এরপরও সেখানে পুলিশের সংখ্যা কম ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
দুর্বল প্রতিরক্ষার সুযোগে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হন। সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপসহ শক্তি প্রয়োগ শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রথমেই পর্যাপ্ত পুলিশ এনে বিক্ষুব্ধ লোকজনকে সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারত।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, পুলিশ প্রথমে শক্তি প্রয়োগ করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। প্রাণহানি এড়াতেই পুলিশ প্রথমে কঠোর হয়নি।
গত সোমবার এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ওই দিন ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। কারও যাতে প্রাণহানি না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার অধীনে দুর্গাপূজায় ৭৪টি মণ্ডপ ছিল। এর প্রায় সবই কোনো না কোনো মন্দিরে। নানুয়া দীঘির পাড়ের মণ্ডপটি কোনো মন্দিরকেন্দ্রিক নয়। এটি অস্থায়ী মণ্ডপ এবং দুর্গাপূজার সময়ই এই মণ্ডপ স্থাপন করা হয়। মণ্ডপটিতে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরাও ছিল না।
স্থানীয় লোকজন জানান, ২০০১ সালে তৎকালীন মন্ত্রী আকবর হোসেন তাঁর বাড়ির সামনে নানুয়া দীঘির পাড়ে প্রথম পূজামণ্ডপ স্থাপনের বিষয়ে উৎসাহ দেন। তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু সুধীর চন্দ্র রায় কর্মকার পূজার আয়োজনের দায়িত্ব পান। এরপর থেকে প্রতিবছরই সেখানে দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপ স্থাপিত হতো। সুধীর মারা যাওয়ার পর তাঁর পরিবারই এই পূজামণ্ডপের দায়িত্বে আছে।
কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শিবপ্রসাদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, স্থায়ী মন্দির না হওয়ায় ওই মণ্ডপ রাত দুইটার পর অরক্ষিত থাকত। এ সুযোগই নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর দাবি, কুমিল্লার ঘটনাটি জাতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ। স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা এগিয়ে না এলে সেদিন আরও বড় ক্ষতি হতে পারত।