বছর পাঁচেক আগের কথা। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরাচিথুলিয়া গ্রামে গরুর খামারের প্রতিবেদন করতে গিয়ে অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা হয়। গ্রামের জয়নাল আবেদিনের বাড়িতে তাঁর ছেলের জ্বর হয়েছে। জ্বর হয়েছে গরুরও। কিন্তু জয়নাল আবেদিন ছেলেকে রেখে গরু নিয়ে ছুটছেন চিকিৎসকের কাছে।
গরু নিয়ে এমন আবেগের শত শত উদাহরণ আছে পাবনা-সিরাজগঞ্জের খামারিদের মধ্যে। কারণ, গরুই এ এলাকার অনেকের একমাত্র আয়ের উৎস। কারও কারও কাছে গরু আবার মর্যাদার প্রতীক।
* ১৮৮২ সালের দিকে ইংরেজ শাসক লর্ড লিন লিথদো এ এলাকায় গরু পালনের সম্ভাবনা আঁচ করেন* লর্ড লিন লিথদো এ এলাকার চাষিদের মধ্যে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উন্নত জাতের ষাঁড় ও গাভি এনে সরবরাহ করেন* ১৮৯৪-৯৫ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন* ভারত থেকে উন্নত জাতের মুলতানি ও সিন্ধি জাতের ষাঁড় ও গাভি এনে কৃষকদের সরবরাহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর* রবীন্দ্রনাথের সরবরাহ করা ষাঁড়ের সঙ্গে স্থানীয় গাভির সংকরায়ণের (ক্রস) মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয় ‘পাবনা ব্রিড’
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও সুজানগর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলার সবখানেই গরুর খামার পাওয়া যায়। এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে গরু নেই, এমন একটা বাড়িও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার আবদুল মোমিন বলেন, ‘ওই দেখেন আমার তিনতলা বাড়ি। আর বাড়ির পাশেই আমার গরুভর্তি গোয়ালঘর। আমাগরে এলাকায় গরু সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। কেউ বাড়ি বানালে লোকে জিজ্ঞেস করবে—বাড়ি তো বানাল্যান, গরু কনে?’
সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ২৫ হাজার দুগ্ধ খামার রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে একটি-দুটি গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে এ এলাকায় ১০ থেকে ১২ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদন করা হয়। আর এই দুধের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে সরকারি মিল্ক ভিটা এবং বেসরকারি প্রাণ ডেইরি, আড়ং দুধ, ফার্ম ফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, পিউরামিল্ক, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরিসহ বেশ কিছু দুগ্ধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে।
শুরুটা যেভাবে হলো
প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮ শতকের গোড়ার দিকে এ এলাকায় দুধের উৎপাদন ও ব্যবসা বাড়তে থাকে। ১৮৮২ সালের দিকে ইংরেজ শাসক লর্ড লিন লিথদো এ এলাকায় গরু পালনের সম্ভাবনা আঁচ করেন। তিনি এ এলাকার চাষিদের মধ্যে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উন্নত জাতের ষাঁড় ও গাভি এনে সরবরাহ করেন।
১৮৯০ সালের দিকে শাহজাদপুরসহ এ এলাকার জমিদারির তদারকির দায়িত্ব পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। কবিগুরু তাঁর জমিদারি তদারকির সময় এ এলাকায় অনেক কীর্তি রেখে যান। দুগ্ধশিল্পের প্রসারও এর মধ্যে অন্যতম। এ এলাকায় দুগ্ধশিল্পের অপার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে ১৮৯৪-৯৫ সালে কবিগুরু কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করেছিলেন। পরে তিনি ভারত থেকে উন্নত জাতের মুলতানি ও সিন্ধি জাতের ষাঁড় ও গাভি এনে কৃষকদের সরবরাহ করেছিলেন। তাঁর সরবরাহ করা ষাঁড়ের সঙ্গে স্থানীয় গাভির সংকরায়ণের (ক্রস) মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয় ‘পাবনা ব্রিড’ নামের এক নতুন প্রজাতির গরু।
কৃষি তথ্য সার্ভিসে (এআইএস) প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, কবিগুরুর সহায়তায় উদ্ভাবিত এই প্রজাতির গরু ‘পাবনা ক্যাটেল’ নামেও পরিচিত। এই জাতের গাভি থেকে ১০ থেকে ১২ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যেত। অবশ্য এখন দেশে আরও উন্নত জাতের গাভি, ষাঁড়ের আমদানি ও উদ্ভাবন হয়েছে। এসব উন্নত জাতের গাভি থেকে এখন ২৫ লিটারের কাছাকাছি দুধ পাওয়া যাচ্ছে।
মনজুর কাদের মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মূলত আমাদের এ এলাকার দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন কবিগুরুর হাত ধরেই হয়েছে। তিনি এ এলাকায় শুধু উন্নত জাতের গাভি ও ষাঁড়ই সরবরাহ করেননি, শাহজাদপুরের অদূরে রাউতারায় প্রায় সাড়ে চার হাজার বিঘা জমি গরু চরানোর জন্য দান করেছিলেন। তাঁর দান করা জমি বাথান নামে পরিচিত। এই বাথানে আজও এলাকার হাজার হাজার গরু চরে বেড়ায়।’
অন্যদিকে এ এলাকায় দুগ্ধশিল্পের আধুনিক প্রেক্ষাপটের সূচনা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। ১৯৭৩ সালে তাঁর উদ্যোগেই শাহজাদপুর উপজেলার বড়াল নদের তীরে বাঘাবাড়ীতে স্থাপন করা হয় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা। শুরুতে এটিই ছিল এ এলাকার একমাত্র দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত ও সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। এখন এ এলাকায় মিল্ক ভিটা ছাড়াও অন্তত ১৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রামে স্থাপিত দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান পিউরা মিল্কের মালিক আবদুর রউফ বলেন, ‘দুগ্ধশিল্প এ এলাকার মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। একে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যেমন হয়েছে, তেমনি ঘরে ঘরে সচ্ছলতাও এসেছে। আমার কারখানাটি ছোট। প্রতিদিন মাত্র চার হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠাই। এরপরও আমার এই কারখানাকে ঘিরে অন্তত ২০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।’
বেড়া পৌর এলাকার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মিনা বলেন, ‘২০১০ সালে দুটি গরু দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার খামারে ৮০টি গরু। প্রতিদিন ৩০০ লিটারের বেশি দুধ হয়। এ ছাড়া বছরে অন্তত ২৫টি গরু খামার থেকে বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে আমার খামার থেকে বছরে ১২ লাখ টাকার মতো আয় হয়। এই খামার আমাকে আর্থিকভাবে শুধু সচ্ছলই করেনি, সম্মান ও মর্যাদাও দিয়েছে।’