>
- রাজীব সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র।
- থাকেন যাত্রাবাড়ীর একটি মেসে।
- রাজীবের মা-বাবা নেই।
- পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন স্বজনদের সহযোগিতায়।
ঢাকা নগরীর দুর্বিনীত যান ডান হাত কেড়ে নিল কলেজছাত্রটির। ২১ বছরের রাজীব প্রতিদিনের মতো কালও বাসে করে যাচ্ছিলেন কলেজে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য মা-বাবা হারানো রাজীবের একমাত্র পথই ছিল পড়াশোনা। ঢাকার সড়কপথে যানবাহনের বেপরোয়া নিষ্ঠুরতা তাঁকে ছুড়ে দিল অসহায়ত্বের শেষ প্রান্তে।
বেলা তখন সোয়া একটা। ভিড়ের কারণে রাজীব দাঁড়িয়ে ছিলেন বিআরটিসির দোতলা বাসের পেছনের ফটকে। হাতটি বেরিয়েছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিক গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দু-তিনজন পথচারী দ্রুত তাঁকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেও বিচ্ছিন্ন সে হাতটি রাজীবের শরীরে আর জুড়ে দিতে পারেননি।
রাজীব হোসেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। থাকেন যাত্রাবাড়ীর মিরহাজিরবাগের একটি মেসে। কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন স্বজনদের সহৃদয় সহযোগিতায়।
ঘটনার পরপর বাংলামোটর থেকে সার্ক ফোয়ারার দিকের সিগন্যালের ঠিক আগে দুটি বাসকে ঘিরে তখন মানুষের জটলা। একই দিক থেকে আসা বিআরটিসির দোতলা বাসটি সড়কের একদম বাঁ পাশে। স্বজন পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৯১১৯) বেপরোয়া বাসটির প্রায় অর্ধেকটাই উঠে গেছে ফুটপাতে। গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাস দুটির মাঝে আটকে থাকা হাতের ছবি মুঠোফোনে তুলছিলেন অনেকে।
রাজধানী ঢাকা শহরের অন্যতম ব্যস্ততম সড়কে সবার চোখের সামনে ঘটল এই ঘটনা। আইন না মানা, বেপরোয়া গতি, যাত্রী নিতে দুই বাসের পাল্লাপাল্লি, যখন-তখন দুর্ঘটনা, দেশজুড়ে এটি এখন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না-কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ, অনেকে হয়ে পড়ছে রাজীবের মতো অসহায়। ডান হাত হারিয়ে রাজীব হোসেনের সামনে এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আরেকটি বাসের যাত্রী আলাউদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুপুর সোয়া একটার মতো হবে। সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে সিগন্যাল পড়েছে মাত্র। এ সময় চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাস থেকে নেমে দেখি ডান হাত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এক যুবক গোঙাচ্ছেন ও চিৎকার করছেন। সারা শরীর রক্তমাখা। অনেকেই মুঠোফোনে ছবি তুলছেন। তখন আমিসহ দু-তিনজন ধরাধরি করে যুবকটিকে একটি রিকশায় করে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমাদের অনুরোধে চিকিৎসকেরা যুবকটির প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘণ্টাখানেক পর দুই বাসের মাঝখানে পড়ে থাকা হাতটি উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। রাজীবের স্বজনেরা হাসপাতালে পৌঁছার পর তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়।’
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাস আটক করে থানায় আনা হয়েছে। দুই বাসেরই চালক ও চালকের সহকারীরা পালিয়ে যান। পরে বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শমরিতা হাসপাতালে কথা হয় রাজীবের চাচা আল আমিনের সঙ্গে। তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের পরিদর্শক। আল আমিন বলেন, চিকিৎসকেরা বলেছেন, রাজীবের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁর হাতটি অস্ত্রোপচারে জোড়া লাগানো যাবে না। রাজীবের মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। বাবা হেলালউদ্দীন। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজীব সবার বড়। বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়ায়। রাজীব টিউশনি করে এবং চাচা, খালাসহ সবার সহযোগিতায় পড়াশোনা করছিলেন।
শমরিতা হাসপাতাল সূত্র বলেছে, বিচ্ছিন্ন হওয়া হাতটি জোড়া লাগানো সম্ভব নয়, তাঁর অবস্থা গুরুতর। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টা তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।