স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দেশে উৎপাদন, উদ্ভাবন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে যে খাতগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, সেগুলোর মধ্যে বেশি এগিয়ে আছে কৃষি। ১৯৭০ সালে কৃষিজমিতে বছরে একটি ফসল হতো, দেশের প্রধান খাদ্যগুলোর বেশির ভাগই ছিল আমদানিনির্ভর।
গত বছর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ বৈশ্বিক কৃষি পরিসংখ্যান প্রতিবেদন বলছে, দেশে এখন বছরে গড়ে দুটি করে ফসল হচ্ছে। কোথাও কোথাও তিন ফসলও হচ্ছে। আর ধান, সবজি, মাছ, ডিম, গরু-ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে গত চার যুগে দেশের কৃষি পরিবার পুরুষপ্রধান থেকে নারীপ্রধান হয়ে উঠেছে। নারীপ্রধান পরিবার ৬৭ শতাংশ।
এফএওর হিসাবে, আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৯৪তম হলেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে ১১তম।দেশে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকের বেশি কমে আসার ক্ষেত্রে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৫ কোটি ৪২ লাখ ৬২ হাজার টন খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে। মোট খাদ্য উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের ওপরে থাকা ১০টি দেশের সব কটি আয়তনের দিক থেকে এ দেশের চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বড়। ওই তালিকায় শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হচ্ছে চীন, ভারত, রাশিয়া।
এ বছর খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রির প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম রয়েছে সবার ওপরে। বিশেষ করে খাদ্যঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তর দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে মনে করছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের পরিচিতি মূলত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাট রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। কিন্তু এখন সীমিত পরিমাণে হলেও চাল, আলু, সবজি, মাছ ও গবাদিপশুর চামড়া রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। আমাদের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণও বাড়ছে; যার বড় অংশ আমদানি করতে হয়। ফলে আমাদের সামনের দিনের কাজ হবে পুষ্টিকর কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো।’
দুই লাখ কোটি টাকার অবদান
১৯৭০ সালে দেশে প্রতি হেক্টরে ধান হতো এক টন, ২০১৯ সালের মধ্যে তা বেড়ে সাড়ে চার টন হয়েছে। স্বাধীনতার পরের বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে চালের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি। ৪৯ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। আর চালের উৎপাদন সাড়ে ৩ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। প্রধান ফসলগুলোর ফলন ৩ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। দেশে শুধু ধানেরই ১১৭টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন দেশের বিজ্ঞানীরা।
এফএওর বিশ্ব পরিসংখ্যান পকেট বুক-২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষকেরা ২০১৭ সালে যে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছেন, তারআর্থিক মূল্য প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। দেশের অর্থনীতিতে কৃষকের এই অবদান ১৯৯৭ সালের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে দেশের মানুষের মাথাপিছু খাদ্যশক্তি (ক্যালরি) গ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ২৮৬ কিলোক্যালরি থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫১৪ কিলোক্যালরি হয়েছে।
দেশের কৃষির এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনি ও সৃজনশীলতাকে সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে কৃষকের পাশাপাশি কৃষিবিজ্ঞানী, সম্প্রসারণকর্মী ও সরকারের নীতিসহায়তাও এ ক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা ১০০টি ধানের উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের মোট উৎপাদিত চালের ৮০ শতাংশই আসছে এই জাতগুলো থেকে। আর বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিনা) বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ১৭টি ধানের জাত।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। আর দেশের কৃষিকে শুধু ধান ও সবজির ওপর নির্ভরশীল রাখলে হবে না। উচ্চমূল্যের ও নানা ধরনের খাদ্য উৎপাদনের দিকেও সরকার নজর দিচ্ছে। দেশের হাওর এলাকা, উপকূলের লবণাক্ত এলাকা এবং পাহাড়ে এখনো বছরে একটা ফসল হয়। তা দুই থেকে তিনটি ফসলে পরিণত করা যাবে। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পাহাড়ে কফিসহ বিদেশি নানা জাতের ফলের চাষকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এসব ফসলের দেশি উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীদের বলেছি। এসব উদ্যোগ সফল হলে কৃষকের জন্য কৃষি লাভজনক পেশা হিসেবে টিকে থাকবে।’
এক ফসল থেকে দুই ফসলি দেশ
ফসলি জমি কমে যাওয়ার পরেও দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির এই বিষয়কে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতে কৃষিজমি কমছে। কারণ, সেখানকার মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের এখানে শিল্পকারখানার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং নানা অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে কৃষিজমি খুব দ্রুত কমছে। কিন্তু আমাদের কৃষকেরা আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। চাল, সবজি ও মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। তবে এই অর্জনকে ধরে রাখতে হলে কৃষিজমি যাতে আর না কমে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’
জমির পরিমাণ না বাড়ার পরও ফসলের উৎপাদন এত বাড়ার উত্তরও এফএওর বিশ্ব কৃষি পরিসংখ্যান প্রতিবেদন-২০১৯ এ রয়েছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ১৯৭০ সালে দেশের ফসলি জমিতে গড়ে একটি ফসল হতো। ১৯৯৭ সালে তা বেড়ে হয় ১ দশমিক ৬ গুণ। ২০১৭ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে দেশের প্রতিটি জমিতে দুটি করে ফসল হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৮৫ লাখ ৫ হাজার ২৭৮ হেক্টর জমিতে ফসলের চাষ হয়। এর মধ্যে ২৪ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৯ হেক্টরে একটি ফসল, ৩৮ লাখ ২০ হাজার ৬৩৭ হেক্টরে দুটি ফসল ও ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬২ হেক্টর জমিতে বছরে তিনটি ফসল হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ও সেচব্যবস্থার উন্নতির মধ্য দিয়ে এক ফসল থেকে দুই ফসলি কৃষির দেশে পরিণত হয়েছি। তবে এই ধারা ধরে রাখতে হলে আমাদের ফসলের আরও আধুনিক জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে।’