প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নে ১৫ তলা ভবন করা হলেও তা কাজে আসছে না। ৯ বছরেও হয়নি জমির সুরাহা।
আকাশমুখী ১৫ তলা সুদৃশ্য ভবনটির অবস্থান রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে। ছয় একর জায়গার ওপর ‘সুবর্ণ’ নামের ভবনটি করা হয়েছিল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা, খেলাধুলা ও তাঁদের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য। ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত সুউচ্চ ভবনটি উদ্বোধন করা হয় প্রায় দুই বছর আগে। কিন্তু চালুর পর থেকে বহুতল ভবনটি শুধু মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। অথচ যাঁদের জন্য এত টাকা খরচ করে ভবনটি করা হলো, তাঁদেরই দেখা নেই সেখানে।
এই চিত্র জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের। প্রতিষ্ঠানটির জনবলসংকটের পাশাপাশি আছে ভবনের জমি নিয়েও জটিলতা। এই জমি ছাড়তে চায় না সমাজসেবা অধিদপ্তর। ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের কাজটিও আটকে আছে। বাদ সাধছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুই প্রতিষ্ঠানের টানাপোড়েনে বন্দী হয়ে পড়ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন।
যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভবনটি করা হয়েছিল, সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে সব কার্যক্রম একটি দপ্তরের অধীনে থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, সচিব, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
পরিকল্পনাটা ছিল এমন, সারা দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেসব পণ্য উৎপাদন করেন, সেগুলোর প্রদর্শনী কেন্দ্র হবে ভবনটিতে। এতে করে প্রতিবন্ধীদের হাতে তৈরি পণ্যের প্রচার ও প্রসার হবে। ভবনটিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে ডে কেয়ার সেন্টার। থাকার কথা আবাসিক সুবিধা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কাউন্সেলিং সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্রও থাকবে। অটিজমসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সেবাদান কার্যক্রমের ব্যবস্থা রাখা আছে ভবনটিতে। দুটি তলা বরাদ্দ দেওয়া আছে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য।
গত ২৭ জুলাই সরেজমিন ঘুরে ভবনের কোথাও প্রতিবন্ধীদের পণ্যের প্রদর্শনী কেন্দ্র দেখা গেল না। ডে কেয়ার সেন্টার চোখে পড়েনি। ১৩ ও ১৪ তলা প্রতিবন্ধীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও আবাসিক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তা জনমানবশূন্য। ভবনের পঞ্চম তলা প্রতিবন্ধীদের ইনডোর সেবাকেন্দ্রের জন্য প্রস্তুত রাখা হলেও অব্যবহৃত পড়ে আছে। নবম তলা অটিজমদের সেবা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হলেও খালি পড়ে আছে। দেখা গেল না প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো বিনোদনকেন্দ্র।
ভবনের ৭, ৮ ও ১১ তলা ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অফিস হিসেবে। সেখানেও আছে জনবলের অভাব। ফাউন্ডেশনের নিজস্ব কর্মকর্তা, প্রেষণে আসা কর্মকর্তাসহ সেখানে মোট জনবল মাত্র ২০ জন। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্মিত ভবনটি কাজেই আসছে না।
কিন্তু এত টাকা খরচ করেও কেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না? জানতে চাইলে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব আনিছুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জনবলসংকটের কারণে সব সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু সেবা চলমান আছে। তিনি বলেন, শূন্য পদের বিপরীতে জনবল চাওয়া হয়েছে। তবে এখনো পাওয়া যায়নি।
এ তো গেল ফাউন্ডেশনের কমপ্লেক্স থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা না পাওয়ার বর্ণনা। ১৯৯৯ সালে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দুই যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন, এমন ভাবনা থেকে এক দশক আগে সাভারে প্রতিবন্ধী ক্রীড়া কমপ্লেক্স করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নামমাত্র এক লাখ টাকার উপহারে ১২ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনকে। কিন্তু এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ক্রীড়া কমপ্লেক্সের জন্য একটি ইটও গাঁথা হয়নি। প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিছুজ্জামান জানালেন, গত এপ্রিলে একনেক সভায় ৪৪৭ কোটি টাকা খরচে ক্রীড়া কমপ্লেক্সের জন্য একটি প্রকল্পের অনুমোদন মিলেছে। এখনো প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ফাউন্ডেশনের ভবনটি যে ছয় একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই জায়গাও তাদের নিজস্ব জমি নয়; সমাজসেবা অধিদপ্তরের। এই জমি হস্তান্তর নিয়ে ৯ বছর ধরে টানাহেঁচড়া চলছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের। কিছুতেইজমি হাতছাড়া করতে চায় না সমাজসেবা অধিদপ্তর।
অথচ ফাউন্ডেশনের জন্য ১৫ তলা বহুতল ভবনটি ২০১৩ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের সময় জমিটি ফাউন্ডেশনের নামে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছিল। এই জমি হস্তান্তর নিয়ে সরকারের দুই দপ্তরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আছে ওই সময় থেকেই।
ছয় একর জমি জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নামে হস্তান্তর করতে সর্বশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর ভার্চ্যুয়ালি এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব জয়নুল বারীর (এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জায়গাটি সমাজসেবা কিংবা ফাউন্ডেশন—দুই দপ্তরের বদলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তর জমি যে হাতছাড়া করতে চায় না, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বরের ওই সভায়। সভার কার্যপত্র থেকে জানা যায়, সভায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সক্ষমতা এখনো হয়নি। যখন সক্ষমতা হবে, তখন দেওয়া যেতে পারে। তার আগপর্যন্ত জমি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নামে থাকাটা যুক্তিযুক্ত।
যদিও সভায় সিদ্ধান্ত ছিল, সমাজসেবাকে জমি ছাড়তে হবে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর হয়নি। এ বিষয়ে জানতে শেখ রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তর ও প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন—দুটোই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব জয়নুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যত দিন ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম, তাতে দুই দপ্তরের মধ্যে চলমান সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।’
সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ভবনটি যে জমির ওপর গড়ে উঠেছে, সেটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে হস্তান্তর হবে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই বিষয়ে কাজ চলছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি আইনি কাঠামো দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করতে একই বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তার তিন বছর পর ২০১৩ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তরের অনুমোদন দিয়ে আদেশ জারি করে। পরের বছর ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। একই দিন তিনি অধিদপ্তরের নামফলক উন্মোচন করেন। ২০১৯ সালে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায়ও ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তরে সবাই একমত হন। কিন্তু ঘোষণার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অধিদপ্তরে রূপ পায়নি ফাউন্ডেশন।
ফাউন্ডেশনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে চাকরিপ্রত্যাশী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদের আহ্বায়ক আলী হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, লাখ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য যা করা দরকার, ফাউন্ডেশন তার ধারেকাছে নেই। তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা চার শতাধিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোথাও কর্মসংস্থান হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি অধিদপ্তর না হওয়া মূল কারণ। প্রতিষ্ঠানটি নিয়োগ দিতে পারে না।
প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি দপ্তর ও বিদেশে তাদের মূল্যায়ন করা হয় এনজিও হিসেবে। কোনো মন্ত্রণালয় তাদের গুরুত্ব দেয় না। ফলে কোনো কাজেই সফলতা আসছে না। অধিদপ্তর হলে দেশি–বিদেশি সবাই গুরুত্ব দিত।
ফাউন্ডেশনকে অধিদপ্তরে রূপান্তর না করতে সমাজসেবা অধিদপ্তর সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের। তাঁদের মতে, ফাউন্ডেশন অধিদপ্তরে রূপান্তরিত হলে প্রতিবন্ধী ভাতার (১৬৫ কোটি টাকা) কার্যক্রম চলে যাবে প্রতিবন্ধী অধিদপ্তরে। এ ছাড়া বুদ্ধি, দৃষ্টি, শ্রবণ এবং বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্ব চলে যাবে প্রতিবন্ধী অধিদপ্তরে। জমির মতো এসব ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চায় না সমাজসেবা অধিদপ্তর।
সারা দেশে এখন প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২২ লাখ। চলমান করোনা মহামারির মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোনো কার্যক্রম নেই ফাউন্ডেশনের। করোনা শুরুর দিকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সারা দেশে মাত্র এক কোটি টাকা বিতরণ করেছিল ফাউন্ডেশন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা বলতে এতটুকুই। তহবিলে পর্যাপ্ত টাকা থাকার পরও প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতায় নীরব ভূমিকায় ফাউন্ডেশন।
২০১৩ সালে ফাউন্ডেশনের জন্য ১৫ তলা ভবনের প্রকল্পটি তৈরি করেছিলেন ওই সময়কার উপসচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। যিনি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভবনটি করা হয়েছিল, সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে সব কার্যক্রম একটি দপ্তরের অধীনে থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।