দুঃসময়ে 'সাময়িক' ভাড়া বৃদ্ধি যাত্রীদের স্থায়ী দুর্ভোগ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

একসময় সংক্রামক রোগে কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। মানুষ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেত, কারণ তারা জানত না কেন কলেরা হয়। এখন পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যায় খুব সহজেই এবং কলেরা থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই এখন আর কলেরা মহামারি হয় না।

ঠিক এমনিভাবে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক পর্যায়ে ভিন্ন রূপ দেখলেও এখন কোন কোন মাধ্যমে এটা ছড়ায় তা আমরা সবাই জানি। করোনা রোগীর থুতু, কাশি, লালা কিংবা চোখের পানি দিয়ে করোনা ছড়ায়। এগুলো আপনার নাক, মুখ চোখের পথ দিয়ে না ঢুকতে দিলে করোনা হওয়ার নয়। শুধু নাক, মুখ, চোখে বাইরের লালা, থুতু, চোখের পানির সঙ্গে যাওয়া ভাইরাস থেকে সতর্ক হলেই আপনি করোনামুক্ত থাকতে পারেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত।

আমরা করোনাভাইরাসের আক্রমণে তাপমাত্রা, আর্থিক অবস্থা কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসেও বিভিন্ন উদ্ভট দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করেছি, যা সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এই ভাইরাস উল্লিখিত মাধ্যমে যে কারও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাই এটি সংক্রমণে এখন যারা ভাবছি, দুই-তিন মাসের মধ্যে ভাইরাসটি চলে যাবে, তারা ভুলের মধ্যে আছি। যারা ভাবছি শিগগির করোনার টিকা বের হয়ে যাবে এবং আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে তারাও। যারা ভাবছি, শুধু ঘরের মধ্যে থেকেই করোনা কাল পার করে ভাইরাসমুক্ত থাকব, তারাও আছি মহা ভুলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে সত্যটি হচ্ছে, কমপক্ষে এক বছর কিংবা তারও বেশি সময় থাকতে পারে এটি। আর এ বছরই কোনো কার্যকর টিকা আপনার হাতে আসছে না কিংবা এলেও আমি-আপনি পাচ্ছি না—এটা হলফ করেই বলা যায়।

আমরা মানুষ; বাকি জীবন ধরে বাসায় বুয়া ছাড়া থাকতে পারলেও বাইরের বাজার ছাড়া, মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া, তার চেয়ে বড় কথা জীবিকা ছাড়া বাঁচতে পারব না।

এই সবকিছু যা-ই করতে যাব, রাস্তায় আমাদের বের হতেই হবে। যার জন্য গণপরিবহন ব্যবহারও মুখ্য।

তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে টানা দুই মাস সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে দ্বিমত থাকার কথা নয় কারও। সরকারকে দেশ বাঁচাতে হলে, অর্থীনীতি বাঁচাতে হলে, গণপরিবহন চালু কিংবা জনস্বার্থে যেকোন সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেটার জন্য চাই নাগরিক সুরক্ষামূলক স্পষ্ট নির্দেশিকা।

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের হার যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন সীমিত পরিসরে হলেও অফিস-আদালত ও গণপরিবহন চালু করা কতটা সংগত, তা নিয়ে অবশ্য রয়েছে পরস্পরবিরোধী মতামত। কিন্তু মহামারির এই সময়ে গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ভিন্ন এক প্রশ্নের মুখে।

দুই মাসের অধিক সময় কর্মহীন যাত্রীসাধারণের এই বাড়তি ভাড়া কতটা বোঝা, তা অনুমেয়। আবার অনুমান করা কঠিন নয় যে ব্যক্তিগত গাড়িহীন জনসাধারণ জীবন-জীবিকার তাগিদে বের হলে গণপরিবহন ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। সেখানে যদি বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়, সেটি হবে এই সময়ে দুর্ভাগ্যজনক।

ভাড়া বৃদ্ধির অন্যতম কারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসে আসনসংখ্যার অর্ধেক যাত্রী তোলার কথা বলা হলেও তা কতটুকু মানা হচ্ছে, তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ।

অস্বীকার করা যাবে না, বেসরকারি মালিকানাধীন গণপরিবহন ব্যবস্থার চালক, সহকারী, শ্রমিক-কর্মচারীরাও করোনাকালের দুঃসময়ের শিকার। তাঁরাও দুই মাস ধরে কর্ম ও উপার্জনহীন। বিপুল বিনিয়োগের গাড়ি অলস বসে থাকায় মালিকদের ক্ষতিও নিশ্চয়ই ধর্তব্য। এর ওপর স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে যদি অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখতে হয়, তাহলে জ্বালানি খরচ ও পারিশ্রমিক ব্যয় তোলাও ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে বটে।

তাহলে কথা হচ্ছে, সর্বব্যাপ্ত এই দুঃসময়ের সেই দায় যাত্রীদের কাঁধে চাপানো কতটা যৌক্তিক?

বিষয়টি অন্যভাবেও দেখার সুযোগ রয়েছে। আমরা দেখেছি নিছক ভাড়া বৃদ্ধি নয়, এক লাফে ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে স্থানীয় এবং দূরপাল্লার বাসগুলো কম যাতায়াত করবে। বরং আগে যেমন পাওয়া যেত, এখনো তা-ই পাবে। তাহলে দুঃসময়ের দায় কেবল যাত্রীই বহন করবে?

গণপরিবহন যাত্রীদের কল্যাণে আরও বিকল্প চিন্তা করা যেত। এই বিকল্প এমন হওয়া উচিত যাতে বাসমালিকেরাও লোকসান গুনবেন না এবং শ্রমিক-কর্মচারীরাও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করবেন না।
বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকে তখন ভর্তুকি দিয়ে সেটা আমাদের দেশে স্থিতিশীল রাখা হয়। কিন্তু ১২ টাকার অকটেনের সুভোগ এ জাতির কপালে নেই। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে জনসাধারণের মাথা আর পকেট কাটাই উত্তম মনে না করে পর্যাপ্ত তেলের মজুত করে মালিকদের পরিবহন খরচও কমানো যেতে পারত। এতে করে ভাড়া বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও কমে যায়।

যাত্রীবান্ধব নীতিতে বাস পরিচালনার ব্যয় যৌক্তিকভাবে হিসাব করে যাত্রীদের কাছ থেকে যে অর্থ কম আদায় হবে, তা সরকারি প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি বাসমালিকদেরও এ মহামারির দুঃসময়ে মুনাফায় ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে এবং শ্রমিককল্যাণ সমিতির নামে শতকোটি টাকাও বেকার চালক-কর্মচারীদের জন্য হতে পারে বড় প্রণোদনা।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বর্ধিত ভাড়া কতটা আগের জায়গায় আসবে, সেই প্রশ্নও রয়ে গেছে। অতীতে আমরা এর নজির দেখিনি। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হলে দুঃসময়ে ‘সাময়িক’ ভাড়া বৃদ্ধি যাত্রীদের স্থায়ী দুর্ভোগ হয়েই থাকবে।

*শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। nuruddin7654@gmail.com