স্বাধীনতার পরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিল্পায়নের লক্ষ্যে পূবালী জুট মিলস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এর উদ্যোক্তারা। গত মাসে পাটকলটি বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন এখানকার প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। এমনিভাবে গত দুই মাসে একে একে বন্ধ হয়েছে বেসরকারি মালিকানার আরও পাঁচটি পাটকল, আর বেকার হয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক।
গত দেড় মাসে ১২টি পাট সুতা উৎপাদনকারী কারখানাও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। ছয়টি সুতাকল উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আর গত তিন বছরের হিসাব ধরলে বন্ধ হওয়া পাট এবং পাট সুতাকলের সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে এসব কারখানায় প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন।
পাট ব্যবসায়ী ও পাটচাষিদের অবস্থা আরও করুণ। পাটের দাম কমে যাচ্ছে, কমেছে রপ্তানি। সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলোর কাছে পাট ব্যবসায়ীদের পাওনা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। পাটকল সমিতির পক্ষ থেকে লোকসানি পাটকল চালু রাখতে সহায়তার জন্য দেনদরবারও করা হচ্ছে। এ নিয়ে একাধিক বৈঠক হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ও বেসরকারি পাটকলগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) বলছে, সরকারের কাছে রপ্তানি ভর্তুকি হিসেবে পাওনা ৬৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় এক কোটি পাটচাষি পড়েছেন মহাবিপাকে। চলতি সপ্তাহে সারা দেশে পাট রোপণ শুরু হয়েছে। এই পাট উঠবে জুনের শেষ থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। একদিকে চাষিরা পুরোনো বকেয়া আদায় করতে পারছেন না, অন্যদিকে পাটের দর পড়ে যাওয়ায় তাঁরা পথে বসার জোগাড়। এ বছর পাট বেচে বেশির ভাগ কৃষক উৎপাদন খরচও তুলতে পারেননি। তার ওপরে আগের বছরের অবিক্রীত পাটের বোঝা তো রয়েছেই।
অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার আশ্বাস ও স্বপ্ন দেখিয়েছিল। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে পাঁচটি বন্ধ পাটকল চালুও করা হয়েছিল। কিন্তু এর বাইরে পাট খাতের দৃশ্যত কোনো উন্নতি হয়নি। বরং সামগ্রিকভাবে পাট খাত আরও ধ্বংসের দিকে আগাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের পাট খাতের সংকট সমাধানে আজ এই খাতের সবাইকে নিয়ে আমরা বৈঠকে বসব। তবে চাই পাট খাত যাতে স্থায়ীভাবে লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে। পাটকলগুলোকেও নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত।
পাট খাতের এই করুণ দশার জন্য আন্তর্জাতিক পাটের বাজারে সংকটের পাশাপাশি দেশীয় বাজারে পাটের ব্যবহার না বাড়ানোকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের ব্যবহার বাড়াতে সরকার ২০১০ সালে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন প্রণয়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এই আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। ২০০৩ সালে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করলেও এখনো বাজারে দেদারসে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। বেসরকারি খাত তো দূরে থাক, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই শতভাগ পাটের ব্যাগের ব্যবহার শুরু করেনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের পাট খাত নিয়ে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে আগানো দরকার ছিল। সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলোর বাজার পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে একটি দিকনির্দেশনা দিলে আজ এই সমস্যা হতো না।
সামনের জুন মাস থেকে পাট রোপণ শুরু হবে। এ বছর পাটের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭০ লাখ বেল। আর এর সঙ্গে যুক্ত হবে গত বছরের অবিক্রীত ২০ লাখ বেল। একসময়কার দেশের সোনালি আঁশের এই বিশাল মজুদ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে একটি বোঝা হিসেবে তৈরি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে সাত লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে ৮৩ লাখ ৯৬ হাজার বেল পাট হয়। এর পরের বছরগুলোতে চাষের এলাকা এবং ফলন দুটোই কমতে কমতে চলতি অর্থবছরে ছয় লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৭৪ লাখ ৩৬ হাজার বেল পাট হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এর পরিমাণ আরও কমবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বিজেএমএর সভাপতি শামসুজ্জোহা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দেশের পাট খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছিল। অথচ দেশে-বিদেশে পাটের বাজারে সংকট, নতুন বাজার সৃষ্টি না হওয়া এবং পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করায় ডুবতে বসেছে পাট খাত।
কমছে রপ্তানি: দেশে বেসরকারি মালিকানায় থাকা পাটকলের সংখ্যা ১৩০টি। এসব পাটকল বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, থাইল্যান্ড ও ইউরোপের বাজারে পাট রপ্তানি করত। ২০১১-এর পর মধ্যপ্রাচ্য সংকট এবং থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাট রপ্তানি কমে যায়। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় তারা বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানি প্রায় বন্ধ করে দেয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি প্রায় সাত হাজার কোটি টাকায় ছুঁয়েছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমে পাঁচ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। জুন নাগাদ তা বড়জোর সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
পাটের দামও ক্রমাগতভাবে কমছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রতি মণ পাট কৃষক দুই থেকে চার হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে প্রতি মণ পাটের দর কমে হয়েছে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী এবং চাষি সমিতির হিসাবে প্রতি মণ পাট কমপক্ষে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করতে না পারলে কৃষকের লাভ থাকে না। ফলে তিন বছর ধরে পাটচাষিরা ক্রমাগত লোকসান গুনছেন।
গত তিন বছরে বন্ধ হওয়া পাটকল: এ আর হাওলাদার জুট মিলস, এলাইড জুট মিলস, দি ঢাকা জুট মিলস, ফৌজি চটকল, নিশাত জুট মিলস, সুলতানা জুট মিলস, তাজ জুট মিলস, প্রিতম জুট জুটেক্স, সালেহ কার্পেট, সালেহ জুট মিলস, খানসনস জুটেক্স, ইসমাইল কার্পেটস, বেঙ্গল কার্পেটস, একেডব্লিইউ বারলেপ অ্যান্ড ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রি, চিটাগাং জুট কোম্পানি, নওয়াব আসকারী জুট মিলস, ন্যাশনাল জুট মিলস, পূবালী জুট মিলস, মহসিন জুট মিলস, জব্বার জুট মিলস, কোহিনূর জুট মিলস ও এজাক্স জুট মিলস।
পাট সুতাকলগুলোর মধ্যে সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে ফাতেমা জুট স্পিনার্স, আজিজ জুট ফাইবার, সালাম জুট মিলস, ফেরদৌস জুট স্পিনার্স ও আলনাস জুট মিলস।