‘দুঃখ’ যখন কম উচ্চতার ২০ সেতু

কম উচ্চতার ২০ সেতু ভেঙে নতুন করে নির্মাণের বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা হলেও বাস্তবায়িত হয়নি।

ঢাকার বৃত্তাকার নৌপথে থাকা ২০টি সেতুর মধ্যে ২টি টঙ্গী খালের ওপর, টঙ্গী সড়ক সেতু-২ ও ৩। পানির সমতল থেকে সেতুর গার্ডার (মূল কাঠামোর তলা) পর্যন্ত যে উচ্চতা রয়েছে, তা দিয়ে কোনো যাত্রীবাহী বড় নৌযান চলতে পারবে না। সম্প্রতি ছবিটি তোলা

সড়কের ওপর চাপ কমাতে ঢাকার বৃত্তাকার নৌপথে যাত্রী পরিবহন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০০ সালে। চার বছর পর ২০০৪ সালে সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটারে প্রথমবারের মতো ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’ চলাচল শুরু হয়। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম আশুলিয়া ও শ্যামপুর পর্যন্ত বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু একাধিকবার পদক্ষেপ নেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত ১১০ কিলোমিটারের পুরো এই নৌপথ চালু করা সম্ভব হয়নি।

এর অন্যতম কারণ, এই নৌপথে কম উচ্চতার ২০টি সেতু। এই সেতুগুলো ভেঙে নতুন করে নির্মাণের বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো নিচু সেতুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রতিশ্রুতিই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, সেতুগুলো প্রতিস্থাপন বা নতুন করে নির্মাণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটা সমীক্ষা চলছে। কারিগরি নিরীক্ষা হয়ে গেলেই কীভাবে সেতুগুলো প্রতিস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এই নৌপথ ঘিরে অনেক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এই নৌপথে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। সমন্বয়ের জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট দরকার ছিল।
শামসুল হক, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক

কম উচ্চতার যত সেতু

বিআইডব্লিউটিএর তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরের চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদ-নদীর ওপর ২৫টি সড়কসেতু ও ৩টি রেলসেতু রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি সেতুরই উচ্চতা কম। সেতুগুলো নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ), রেলওয়ে, রাজউক এবং এলজিইডি।

বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে, ঢাকার বৃত্তাকার নৌপথে কম উচ্চতার সেতুগুলো হলো বছিলা সেতু, আমিনবাজার সেতু (গাবতলী), আশুলিয়া সেতু, ধউর সেতু, বিরুলিয়া সেতু, প্রত্যাশা সেতু, কামারপাড়া সেতু-১, কামারপাড়া সেতু-২, টঙ্গী সড়কসেতু-২, টঙ্গী সড়কসেতু-৩, টঙ্গী রেলসেতু-১, টঙ্গী রেলসেতু-২, টঙ্গী রেলসেতু-৩, তেরমুখ সেতু, পূর্বাচল সেতু, কায়েতপাড়া সেতু, চনপাড়া সেতু, কাঁচপুর সেতু-১, বেরাইদ বেইলি সেতু ও ইছাপুরা ভাঙা সেতু।

সারা দেশের নৌপথগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তুরাগ নদের ওপর আশুলিয়া সেতুটি যে অঞ্চলে, সেই নৌপথ তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। শ্রেণি অনুযায়ী, পানির সমতল থেকে সেতুর গার্ডার পর্যন্ত সেখানে উচ্চতা ২৫ ফুট থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ২ দশমিক ২০ ফুট। এই উচ্চতা দিয়ে কোনো ছোট নৌযানও চালানো সম্ভব নয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, আশুলিয়া সেতুটি যে স্থানে রয়েছে, তার আগে রয়েছে আশুলিয়া টার্মিনাল। পণ্যবাহী নৌযানগুলো এখানে মালামাল খালাস করে। কম উচ্চতার সেতুর কারণে নৌযানগুলো সরাসরি নদীটি অতিক্রম করতে পারে না। এ এলাকা অতিক্রম করতে চাওয়া নৌযানকে কয়েক কিলোমিটার ঘুরে বিকল্প পথে যেতে হয়। এখানে নির্বিঘ্নে যাত্রীবাহী সার্ভিস চালাতে হলে সেতু না ভেঙে উপায় নেই বলে মত দিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএসহ নৌপথসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সওজ ২০১০ সালে টঙ্গী খালের ওপর পুরোনো কামারপাড়া সেতুর পাশে নতুন সেতু তৈরির কাজ শুরু করে। গত বছর এর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানায় বিআইডব্লিউটিএ। গত বছরের জুলাইয়ে এ নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে সেতুর উচ্চতা বাড়াতে এবং মাঝখানে স্টিলের স্প্যান বসাতে রাজি হয় সওজ। তবে স্টিলের স্প্যান বসালেও প্রতিশ্রুত উচ্চতা না রেখেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছে সওজ।

বিআইডব্লিউটিএ কামারপাড়া সেতুর উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর সওজ উল্টো বিআইডব্লিউটিএর নির্ধারিত পরিমাপ কাঠামো নিয়ে আপত্তি জানায়। সওজের যুক্তি ছিল, নদী শ্রেণি ও সেতু তৈরিতে উচ্চতা নির্ধারণে বিআইডব্লিউটিএর পরিমাপ কাঠামো হালনাগাদ নয়।

এ অবস্থায় পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নির্দেশে সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের ৯৯টি সেতুর উচ্চতা মাপে বিআইডব্লিউটিএ। তাতে ৮৩টি সেতুর উচ্চতাই নৌপথের শ্রেণি অনুযায়ী কম পাওয়া গেছে। তখন সেতুর কম উচ্চতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে আলোচনা হয় এবং গত ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেকের বৈঠকেও বিষয়টি ওঠে। প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে উচ্চতা ঠিক রেখে সেতু বানাতে নির্দেশ দেন।

সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তুরাগ নদের ওপর ধউর এলাকায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও বিআইডব্লিউটিএর আপত্তির পর কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে নদীর দুই পাশে থাকা সেতুর পিলার নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। অপরদিকে বালু নদের ওপর ইছাপুরা সেতুটি বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নিয়েই তৈরি করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন এলজিইডি নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ তাজুল ইসলাম। একই নদীর ওপর কায়েতপাড়া সেতু প্রায় ১৪ বছর ধরে নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। সরেজমিনে নির্মাণাধীন অবস্থায় সেতুর পিলার দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলো নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

বেরাইদ বেইলি সেতু ও ইছাপুরা ভাঙা সেতুও নির্মাণাধীন অবস্থায় নৌপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

সওজের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, টঙ্গী সড়কসেতুর জায়গায় ১০ লেনের বিআরটি (বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট) লাইন তৈরি হচ্ছে। এটির উচ্চতা অনেক বেশি থাকায় নিচের সেতু দুটি (টঙ্গী সড়কসেতু-২ ও ৩) ভেঙে ফেলা হবে।

বৃত্তাকার নৌপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা সেতুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম উচ্চতায় থাকা আশুলিয়া সেতু ও সম্প্রতি নির্মাণ শেষ হওয়া কামারপাড়া সেতু ভেঙে ফেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে জানান সবুজ উদ্দিন খান। তবে কবে এগুলো ভাঙা হবে, সে ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত সওজ নেয়নি বলে জানান তিনি।

সওজ বৃত্তাকার নৌপথে থাকা তাদের নির্মিত সেতুগুলোর উচ্চতা ঠিক আছে দাবি করলেও আমিনবাজার সেতু, বিরুলিয়া সেতু, তেরমুখ সেতু, কাঁচপুর সেতু-১-এর উচ্চতা নৌপথের শ্রেণি অনুযায়ী কম রয়েছে বলে বলছে বিআইডব্লিউটিএ। সংস্থাটি জানিয়েছে, শুধু সওজ নয়, বৃত্তাকার নৌপথের বেশির ভাগ সেতু নির্মাণের সময় নৌপথের শ্রেণি অনুযায়ী উচ্চতা রাখেনি অন্য নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও।

টঙ্গীতে তুরাগ নদের ওপর থাকা পূর্বের রেলসেতু দুটি পানির সমতল থেকে উচ্চতা ছিল ছয় ফুট ও চার ফুট ছয় ইঞ্চি। সেতু দুটির ঠিক মাঝখানে নির্মাণাধীন নতুন রেলসেতুর উচ্চতা প্রথমে সাড়ে ৩ মিটার ধরা হয়েছিল। বিআইডব্লিউটিএর আপত্তির পরে ২ মিটার বাড়ানো হয়। বর্ষায় পানি বাড়লে এই সেতুর নিচ দিয়ে নৌযান চলতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নির্মাণাধীন টঙ্গী রেলসেতুর সদ্য বদলি হওয়া প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ নৌপথের শ্রেণি অনুযায়ী এই সেতুর উচ্চতা ৭ দশমিক ৬২ মিটার রাখতে বলেছিল। কিন্তু সাড়ে ৫ মিটারের চেয়ে বেশি উচ্চতা বাড়ানো আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

এলজিইডি বলছে, নৌপথের শ্রেণি অনুযায়ী যে উচ্চতায় সেতু নির্মাণ করা প্রয়োজন, টঙ্গী রেলসেতুটি অনেক কম উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে। কম উচ্চতার রেলসেতু রেখে অধিক উচ্চতার সেতু নির্মাণ করলে তা কোনো কাজে আসবে না।

এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলওয়ের সেতুগুলোর উচ্চতা না বাড়ালে আমাদের সেতুর উচ্চতা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। তাই রেলওয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই আমরা আমাদের সেতুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

বৃত্তাকার নৌপথের মধ্যে কাউন্দিয়া সিন্নিরটেক সেতু, রুস্তমপুর সেতু এবং উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন দেওয়ান বেড়িবাঁধ সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে এলজিইডি। এসব সেতু বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নিয়ে করা হবে বলে আশ্বাস দেন মোশাররফ হোসেন।

সমন্বয়ের জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট

বৃত্তাকার নৌপথে দিনে দিনে এত কম উচ্চতার সেতু গড়ে ওঠার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা একটা ব্যতিক্রম শহর, যার চারপাশে নৌপথ আছে। এই নৌপথ ঘিরে অনেক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এই নৌপথে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। সমন্বয়ের জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট দরকার ছিল। কাজটা মানসম্মত, পূর্ণাঙ্গ হলো কি না, দেখার কেউ নেই।

শামসুল হক বলেন, দেশে পরিকল্পিত উন্নয়ন হওয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশন অভিভাবক কর্তৃপক্ষ হতে পারত। কারণ, তাদের কাছে নৌ প্রকল্প যায়, রেল ও সড়কের প্রকল্পও যায়। ফলে তিনটার মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হচ্ছে কি না, পরিকল্পনা কমিশন তা দেখতে পারত।

শামসুল হক আরও বলেন, এখন প্রতিস্থাপন না করে কম উচ্চতার এই সেতুগুলো ভাঙা যাবে না। কারণ, প্রতিটি ‘অ্যাকটিভ’ ব্রিজ।