সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের দুটি ছবি। একটিতে পাকিস্তানের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে হাত বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। পরনে কালো জোব্বা। অন্যটি সম্প্রতি কাবুল দখলের পর। সফেদ জোব্বার ওপর কটি ও মাথায় পাগড়ি পরে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বসে আছেন মোল্লা আবদুল গনি।
ছবির নিচে ক্যাপশন, ‘অনেক কিছু ভাবায়, খেয়াল করে দেখুন।’ মন্তব্যের পাশে এমন ইমোজি ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে পরিষ্কার, পোস্টদাতা উল্লসিত। আরও পোস্ট আছে। এগুলো তালেবানদের হাতে কাবুলের পতনের পর মিষ্টি ও বিরিয়ানি বিতরণ কিংবা আফগানিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা। বেশ কিছু গানও বাঁধা হয়েছে তালেবানদের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে। ২০১৬ সালে ঢাকা থেকে আফগানিস্তানে যান এক তরুণ। ওই বছরই নিহত হন তিনি। তাঁর ভিডিও নতুন করে শেয়ার করা হয়েছে। তালেবানদের নৃশংসতার কথা কেউ তুললেই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে কাউকে কাউকে।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, কট্টরপন্থী সুন্নিদের দল তালেবানের এই ফিরে আসা আসলে কী প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশে? জঙ্গিবাদ দমনে নিয়োজিত পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত তাঁরা শঙ্কায় নেই। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বিষয়টি অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এর মধ্যেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তালেবানের পক্ষ থেকে আফগানিস্তান যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। আর বাংলাদেশ থেকে কিছু মানুষ ইতিমধ্যে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আমরা ধারণা করছি, কিছু মানুষ ভারতে ধরা পড়েছে, আর কিছু হেঁটে বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।’ যদিও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বা অ্যান্টি–টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা দলে দলে আফগানিস্তানের উদ্দেশে তরুণদের দেশ ছাড়ার কোনো খবর নিশ্চিত করতে পারেননি।
সিটিটিসির প্রধান ও উপমহাপরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আফগানিস্তানের এই পটপরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শঙ্কিত নয়, তবে সতর্ক। এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে, তা হলো কয়েকটি পক্ষের উল্লাস। একজন মানুষ যে মতাদর্শ অনুসরণ করে থাকেন, সেই মতাদর্শ কোথাও জয়ী হলে তিনি উল্লসিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের খাতায় আফগানিস্তানে গেছেন—এমন তরুণের সংখ্যা দুই। আনসার আল ইসলাম তাদের নিজস্ব চ্যানেলে আফগানিস্তানে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তরুণদের প্রতি। তাতে খুব সাড়া পাওয়া গেছে, এমন নয়। বিশেষ করে তালেবান বিদেশি ‘যোদ্ধা’দের আমন্ত্রণ জানায়নি। তারা বলেই দিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি তারা জঙ্গিবাদে ব্যবহৃত হতে দেবে না।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে যাওয়াও খুব সহজ নয়। এর আগে যাঁরা গেছেন, তাঁরা ভারত হয়ে গেছেন। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সতর্ক আছে। বাংলাদেশও যথেষ্ট সতর্ক আছে।
দীর্ঘ মেয়াদে দুটি পরিবর্তনের কথা বলছে পুলিশ। প্রথমত, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে জঙ্গিদের আশ্রয় দিতে পারে তালেবান। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
সিটিটিসি গত ১০ মে ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী চার তরুণকে গ্রেপ্তার করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণেরা জানান, তাঁদের দুই সঙ্গী আফগানিস্তানে চলে গেছেন।
ওই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত সিটিটিসির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সাংগঠনিক অবস্থা এখন খুবই দুর্বল। কিন্তু আল–কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকির কারণ হতে পারে। গ্রেপ্তারকৃত চার তরুণ ছিলেন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তাঁদের যে দুই সহযোগী আফগানিস্তানে চলে গেছেন, তাঁরা সে দেশে অবস্থানকারী আল–কায়েদা বা তাদের কোনো প্রতিনিধির আমন্ত্রণ পেয়েই গেছেন—এমন একটা আশঙ্কা আছে।
কাবুল পতনের পর বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় মার্কিনদের সঙ্গে তালেবানের চুক্তি হয়। ওই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল তালেবান আল–কায়েদা বা অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঘাঁটি গাড়তে দেবে না। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদও আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে একই কথা বলেন। এর আগে দোহায় তালেবানদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে তারা কোনো ‘বিদেশি যোদ্ধার’ সহযোগিতা নেননি। এ মুহূর্তে তারা সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। ন্যাটোর হিসাবে তাদের কর্মীসংখ্যা এখন ৮৫ হাজার।
বিবিসি অবশ্য বলেছে, তারা তালেবানের দলটিতে বিদেশিদের দেখতে পেয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে, সেটাও সত্য নয়। জাতিসংঘের ইসলামিক স্টেট, আল–কায়েদা এবং তালেবানের পর্যবেক্ষণকারী দলের সমন্বয়ক ফিটন-ব্রাউন বিবিসিকে বলেন, তালেবান ও আল-কায়েদা পরস্পরের মিত্র হিসেবে কাজ করার ব্যাপারে একমত। তালেবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় থাকবে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের খবর, আফগানিস্তানের বেশ কিছু এলাকায় শাসনব্যবস্থা কার্যকর করা কঠিন। সেখানেও আশ্রয় নিতে পারে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো। এর আগে ওসামা বিন লাদেনকে সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি আল–কায়েদার প্রায় ২০ হাজার জঙ্গি প্রশিক্ষণ পায় আফগানিস্তানে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আফগানিস্তানে জঙ্গিরা শক্তিশালী হয়ে উঠলে তার একটা প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়বে।
অপর যে ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে, তা হলো আফগানিস্তানের কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশিরাও আছেন। কমপক্ষে তিনজন পালিয়ে গেছেন—এমন খবরও তাঁরা পেয়েছেন। তানভীর নামের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা রয়েছেন সেখানে, তাঁর কোনো খোঁজ নেই। তাঁরা বাংলাদেশে ফেরার একটা চেষ্টা করতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রবেশপথগুলোয় বাড়তি সতর্কতার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না, তা জানতে কথা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক হায়দার আলী খানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তগুলো বরাবরের মতোই সতর্ক অবস্থায় আছে।
১৯৮৯ সালে আফগান মুজাহিদদের কাছে পরাজিত হয়ে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ছেড়ে যায়। আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে সে সময় বাংলাদেশের মাদ্রাসাপড়ুয়া কিছু ছাত্রও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে হরকাতুল জিহাদ-বাংলাদেশ (হুজি-বি) গঠন করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক, পরে তাঁরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হন। একক দল হিসেবে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলাগুলো চালায় দলটি।
রুশ বাহিনী প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের কান্দাহারেও মাদ্রাসাছাত্র ও শিক্ষকেরা একই সময় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই লেখাপড়া পাকিস্তানের মাদ্রাসায়। ‘তালেবান’ শব্দটি পশতু ভাষার, এর অর্থও ছাত্র।
ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, তালেবানদের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার এ ঘটনায় বাংলাদেশে উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর উত্থানের আশঙ্কা বেড়েছে। দুই যুগ আগেও তালেবানের উত্থানের সময় বাংলাদেশে কিছু উগ্রপন্থী দল ও সংগঠন এক হয়ে রাজনৈতিক অবস্থান তৈরির চেষ্টা চালিয়েছিল। মাদ্রাসাছাত্রদের একটি বড় অংশ তালেবানের কাবুল দখলকে ‘অনুপ্রেরণাদায়ী’ মনে করছেন। তালেবানদের সঙ্গে নিজেদের মিল খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে। ফেসবুক ও এর নিয়ন্ত্রণাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ‘তালেবান’ শব্দ লেখার ওপর একধরনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত পেজগুলোয় ‘ছাত্রভাইয়েরা’ বা ‘ছাত্রবন্ধুরা’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে তালেবানকে।
দেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর তৎপরতার খোঁজখবর রাখেন ইসলামি চিন্তক শরীফ মুহম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩-১৪ সালে ইসলামপন্থী দলগুলোর মোর্চার যে সক্ষমতা ছিল, তা এখন আর নেই। তবে আফগানিস্তানে তালবানদের উত্থানে এ দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো কোনো ধরনের অনুপ্রেরণা বোধ করবে না, বিষয়টা এমন নয়। তারা হয়তো কিছু কাজ করবে। কিন্তু তারা বড় কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হবে কিংবা সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত হবে বলে তিনি মনে করেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান মনে করেন, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন। এই দফায় তালেবান বেশ কিছু বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আগে দেয়নি। তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক চায়। এখন পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বা নারীদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তারা কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমা করে দিয়ে কাজে ফিরতে আহ্বান জানিয়েছে। উগ্রবাদী আচরণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। সবাইকে কাজে ফিরে যেত আশ্বস্ত করছে। সুতরাং তালেবানকে উগ্রবাদী হিসেবে আখ্যা দেওয়াটা এ মুহূর্তে ভুল হবে। তবে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টা থেকে সরে এলে পরিস্থিতি অন্য রকম হবে।
সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর, ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের বড় অংশ তালেবানদের দখলে এসেছিল। সরকার গঠনের প্রথম পর্যায়ে দুর্নীতি রোধ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা ছিল তাদের। তারা জনপ্রিয়তাও পায়। কিন্তু কিছুদিন পরই তারা শরিয়া আইন প্রবর্তনের নামে নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। হত্যা ও ব্যভিচারের অপরাধে প্রকাশ্যে হত্যা, ১০ বছর বয়সের পর মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া, পুরুষদের জন্য দাড়ি ও মেয়েদের জন্য বোরকা বাধ্যতামূলক করাসহ নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তারা। দুই দশক পর তালেবানই আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে।