দিন দিন বাড়ছে জলাবদ্ধ এলাকা

বর্ষা আসতে বেশি বাকি নেই। এখনো চলছে পয়োনিষ্কাশন লাইন বসানোর কাজ। গতকাল শাহজাহানপুর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
বর্ষা আসতে বেশি বাকি নেই। এখনো চলছে পয়োনিষ্কাশন লাইন বসানোর কাজ। গতকাল শাহজাহানপুর এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার জলাবদ্ধতা কমাতে সরকারি সংস্থাগুলো প্রতিবছর বিপুল টাকা খরচ করছে। কিন্তু জলাবদ্ধ এলাকার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত বছর 

সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে এমন ১৫টি এলাকার সঙ্গে এ বছর আরও নতুন এলাকা যুক্ত হয়েছে।

জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী মৌলিক কারণগুলো সমাধান না করায় ভরা বর্ষায় এমন এলাকা আরও বাড়তে পারে। জলাবদ্ধতার বড় কারণ হলো ক্যাচপিট (নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা) বন্ধ থাকা, নালা দিয়ে পানি না নামা, খাল সংস্কার না করা, জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা ভরাট করা।ক্যাচপিট থেকে বন্যাপ্রবাহ এলাকা পর্যন্ত পানিপ্রবাহে বড় বাধা ময়লা-আবর্জনা। আবর্জনা জমেই মূলত রাস্তার পানি নামার নালাগুলো ভরে যায়, বন্ধ হয়ে থাকে। তার ওপর আছে নদী দখল, জলাধার ভরাটের ঘটনা।

গতবারের দীর্ঘ বর্ষায় প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী-বাসীকে জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। এবার প্রাক্‌-বর্ষায় শুরু হওয়া বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর রাস্তাঘাট। সামান্য বৃষ্টিতে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি জমে থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

গত বছর সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হয়েছিল এমন ১৫টি এলাকা ছিল শান্তিনগর, মালিবাগ ও মৌচাক এলাকা; ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের মাথা, মতিঝিল, পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন ও উমেশ দত্ত রোড, বংশাল রোড, বঙ্গভবন ও টিকাটুলীর অভয় দাস লেন, মুগদা, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, কারওয়ান বাজার, তেজকুনী পাড়া, তেজতুরী বাজার গার্ডেন রোড, মিরপুরের কাজীপাড়া, খিলক্ষেত, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের কিছু অংশ।

এসব এলাকার সঙ্গে এবার জলাবদ্ধতার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মিরপুর ১০ নম্বর, মনিপুর, শেওড়াপাড়া ও বিজয় সরণি। দৃশ্যত মেট্রোরেলের জন্য রাস্তা খোঁড়ার কারণে পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। গত বুধবার ঢাকায় ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। তাতেই এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

কাজীপাড়া এলাকার পানিনিষ্কাশনের নালা সংস্কার করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গত বছরের জুলাইয়ে শুরু হওয়া কাজ শেষ হয়েছে এই বছরের মার্চের শেষ দিকে। নালা ও সড়ক সংস্কারে এখানে খরচ করা হয়েছে ২২ কোটি টাকা।

ক্যাচপিট বন্ধ: বৃষ্টির পানি ক্যাচপিটের মাধ্যমে নিষ্কাশন নালায় যায়। ওয়াসার গভীর নর্দমার সঙ্গে এই ক্যাচপিটগুলো সংযুক্ত।

ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার আড়াই হাজারের বেশি ক্যাচপিট আছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সড়ক, ফুটপাত এবং নর্দমার নির্মাণ ও সংস্কারকাজের সময় হাজারখানেক ক্যাচপিট ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো হয়ে পড়েছে। এখন ওয়াসা নতুন করে এক হাজার ক্যাচপিট নির্মাণ করছে।

তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কুদরতউল্লাহ বলেন, ঢালাওভাবে ক্যাচপিট বন্ধ বললে হবে না। উন্নয়নকাজ চলার সময় কোথাও বন্ধ থাকতে পারে। সেটি সাময়িক। 

নালা দিয়ে পানি সরে না
ঢাকা শহরের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের বর্জ্যের শতভাগ সঠিক মাত্রায় সংগ্রহ হয় না। ফুটপাতে থাকা অসংখ্য অবৈধ দোকানপাট থেকে চা পাতা, কলার খোসা, চিপসের প্যাকেটসহ নানা বর্জ্য সরাসরি নালায় ফেলা হয়। ফলে নালা বন্ধ হয়ে যায়, পানি সরতে পারে না।

দুই সিটি করপোরেশনের নিষ্কাশনের নালা রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। এগুলো গিয়ে মিশেছে ওয়াসার গভীর নর্দমা বা স্টর্ম স্যুয়ারেজের সঙ্গে। ওয়াসার ৩৭০ কিলোমিটার এমন নালা আছে। বৃষ্টির পানি এসব নালা হয়ে খাল, নদী ও জলাশয়ে গিয়ে পড়ে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন এলাকায় ২৩৯ কিলোমিটার নতুন নালা তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কার করা হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় নর্দমা নির্মাণের কাজ এখনো চলছে।

মালিবাগ, মৌচাক ও শান্তিনগর এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন ও সড়ক-ফুটপাত সংস্কারে ৭৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় মূল সড়কের পাশের নালা সংস্কার করা হলেও এলাকার ভেতরের সড়কের নালাগুলো বালু ও ময়লায় ভরাট হয়ে আছে।

শান্তিনগর পীর সাহেব গলির বাসিন্দা বাবুল আহমেদ বলেন, কিছুদিন আগে এলাকার লোকজন অভিযোগ করায় সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে দেখেও গেছেন, কিন্তু সংস্কার করা হয়নি। তিনি বলেন, নালা পরিষ্কার না থাকায় এলাকার বৃষ্টির পানি চার-পাঁচ ঘণ্টায়ও মূল নালায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে না।

তবে দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-২-এর নির্বাহী কর্মকর্তা হানিফ পাটোয়ারী বলেন, এলাকার ভেতরের নালা সংস্কারের জন্য আলাদা প্যাকেজে অর্থ বরাদ্দ আছে। সেই প্যাকেজের আওতায় এগুলো সংস্কার হবে।

উত্তর সিটির আওতায় নালা রয়েছে ১ হাজার ২০২ কিলোমিটার। বর্ষা সামনে রেখে এগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কুদরতউল্লাহ।

ওয়াসা জানিয়েছে, বর্ষা শুরুর আগে তারা তাদের ৩৭০ কিলোমিটার নিষ্কাশন নালার ২৯০ কিলোমিটার পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছে।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংস্থাগুলোর কাজ দেখে মনে হচ্ছে এ বছরও তারা জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে হলে পানিনিষ্কাশনের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। 

খাল সংস্কারে উদ্যোগ
ওয়াসার তদারকিতে আছে ঢাকার ২৬ খাল। বারোয়ারি বর্জ্য জমতে জমতে বেশির ভাগ খালেরই পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ফলে ওয়াসার নালা দিয়ে পানি খালে গেলেও তা সরতে অতিরিক্ত সময় লাগছে।

ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এবার খালের গভীরতা বাড়ানো হচ্ছে, যাতে পানি ধারণসক্ষমতা বাড়ে।

গত মঙ্গলবার রামচন্দ্রপুর খালের মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটির সামনের অংশে গিয়ে দেখা যায়, এক্সকাভেটর যন্ত্রের মাধ্যমে খাল থেকে বারোয়ারি বর্জ্য ও মাটি তোলা হচ্ছে। কাজ তদারককারী ব্যক্তি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বৃষ্টির কারণে প্রায়ই কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, খাল খনন ও নালা পরিষ্কারের কাজ মার্চ মাসের মধ্যে শেষ করা উচিত ছিল। সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। 

জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা কমছে
নগরবিদেরা বলছেন, শহরের মোট ভূমির ১২ ভাগ জলাধার থাকা দরকার। ঢাকায় আছে মাত্র ২ ভাগ। এর মধ্যে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) একের পর এক সংশোধনী এনে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫৮টি সংশোধনীর গ্যাজেট হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি সংশোধনীর মাধ্যমে বন্যাপ্রবাহ এলাকায় আবাসন প্রকল্প, একটিতে শিল্পকারখানা ও অন্যটির মাধ্যমে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নগরবিদেরা বলছেন, বন্যাপ্রবাহ এলাকা ধ্বংস হলে নিষ্কাশনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে ও শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হবে।

ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে হলে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল মুক্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই। খাল-নদী উদ্ধার করতেই হবে। এখনো যেটুকু বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল মুক্ত আছে, জরুরি ভিত্তিতে তা সংরক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন।