দিনভর ভোগান্তির পর রাতে বাস–লঞ্চ চলার অনুমতি

রাত থেকে কিছু বাস চলছে। বাসে উঠতে না পেরে কেউ কেউ হেঁটেই গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তায় রাত ১০টার চিত্র। গাজীপুর, ৩১ জুলাই
 ছবি: মাসুদ রানা

কারখানা খোলার ঘোষণা শুনে গত শুক্রবার রাতে নাটোর থেকে রওনা দেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হোসেন। বাস চলাচল বন্ধ, তাই মরিয়া হয়ে ট্রাকে চড়ে বসেছিলেন তিনি। তিন দফা ট্রাক বদল করে গতকাল শনিবার সকালে পৌঁছান সাভারের নবীনগরে। এরপর মোটরসাইকেলে আমিনবাজার এবং সেখান থেকে হেঁটে গাবতলী পর্যন্ত আসেন।

শুধু আবুল হোসেনই নন, শুক্রবার রপ্তানিমুখী কারখানা খোলার ঘোষণার পর বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। কেউ ট্রাকে, কেউ অটোরিকশায়, কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ ভ্যানে করে দূরের পথের যাত্রা করেন। দিনভর শ্রমিকের এই ভোগান্তির পর গতকাল সন্ধ্যা সাতটার পর সরকার জানায়, শ্রমিকদের চলাচলের জন্য আজ রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাস, লঞ্চসহ গণপরিবহন চলবে।

এ ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দায়িত্বশীলদের দূরদর্শিতার অভাব প্রকট। কারখানা খুললে শ্রমিকের যে ঢল নামে, তা গত বছরই দেখা গেছে। সবকিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। শ্রমিকেরা যেভাবে গাদাগাদি করে চলাচল করেছেন, তাতে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ভোগান্তির পাশাপাশি শ্রমিকদের বাড়তি ব্যয়ও করতে হয়েছে। পোশাক কারখানার কর্মী দুই বোন মরিয়ম ও স্বপ্না কারখানায় যোগদান করার নির্দেশনা পেয়ে ময়মনসিংহের ফুলপুরে নিজেদের বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে। পিকআপ ভ্যান, রিকশা, পায়ে হাঁটাসহ নানাভাবে টঙ্গীর আবদুল্লাহপুরে পৌঁছান গতকাল সকাল ১০টার দিকে। দুজনের খরচ হয় ১ হাজার ৬৬০ টাকা।

কথা বলার একপর্যায়ে চরম বিরক্তি নিয়ে স্বপ্না বলেন, ‘আপনারা এসব লেইখখা কী করবেন? আমরা গরিব মানুষ, আমগোর কষ্ট সারা জীবনই থাকব। এক দিকে কারখানার চাপ, অন্যদিকে ভোগান্তি। আমরা যামু কই?’

অনেক শ্রমিককে মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে অথবা ফোন করে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাবতলীতে কথা হয় রত্না বেগম নামের ৩৫ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে। তিনি কাজ করেন নারায়ণগঞ্জ ইপিজেড এলাকার একটি পোশাক কারখানায়। রত্না বেগম বলেন, ‌শুক্রবার রাতে কারখানা থেকে মুঠোফোনে জানানো হয়, রোববার কাজে যোগ দিতে হবে। সকাল ১০টার মধ্যে কারখানায় থাকতে হবে। ভোরে তাঁর ভাই মোটরসাইকেলে করে পাটুরিয়া ঘাটে নামিয়ে দিয়ে যান। ঘাট পার হয়ে দুই হাজার টাকায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নবীনগর আসেন। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে ৪০০ টাকা দিয়ে আমিনবাজার পর্যন্ত আসেন। তারপর হেঁটে আসেন গাবতলীতে।

গতকাল সকাল ১০টার দিকে গাবতলীতে গিয়ে দেখা যায় ঢাকামুখী মানুষের ঢল। আমিনবাজারের দিক থেকে গাবতলীর দিকে মানুষ হেঁটে আসছিলেন। সেখান থেকে কেউ হেঁটে, কেউ রিকশায় আবার কেউ মোটরসাইকেলে করে গন্তব্যের পথ ধরেন। শুধু ঢাকায় প্রবেশই নয়, রাজধানী থেকে সাভারের দিকেও বহু মানুষকে ছুটতে দেখা যায়।

ফেরিতে গাদাগাদি করে পদ্মা পার

বিধিনিষেধের কারণে পদ্মা পারাপারে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে গতকাল সকাল থেকে ঢাকামুখী জনস্রোতের প্রচণ্ড ভিড় হয় ফেরিগুলোতে। শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে যেসব ফেরি আসে, সেগুলোতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এদিন মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও শিমুলিয়া নৌপথে নয়টি ফেরি চলাচল করে। আটটি ফেরি চলে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে।

গতকাল সকালে শিমুলিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাবাজার থেকে আসা সব ফেরি যাত্রীতে পূর্ণ। সন্ধ্যায়ও ছিল একই চিত্র।

বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. শাফায়াত আহম্মেদ বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটের অবস্থা একই রকম। ঢাকামুখী যাত্রীর চাপ যেন কোনোভাবেই কমছে না।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দৌলতদিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে ফরিদপুর নামের একটি ফেরি পাটুরিয়া ৩ নম্বর ঘাটের পন্টুনে ভেড়ে। এ সময় ফেরিতে গাদাগাদি করে যাত্রীদের নদী পার হতে দেখা যায়। যাত্রীদের ভিড়ে ফেরিতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ফেরি থেকে নামার পর চার-পাঁচ গুণ বাড়তি ভাড়া দিয়ে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ছোট বাহনে নিজ নিজ গন্তব্যে ছোটেন যাত্রীরা।

মহাসড়কে ভিড়

ঢাকার আবদুল্লাহপুর মোড়ে গতকাল সকালে দেখা যায় হাজারো মানুষের ভিড়। কারও হাতে ব্যাগ, কারও কোলে শিশু, কারও মাথায় বস্তা। কেউ হাঁটছিলেন, কেউ যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কেউবা যানবাহনের ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করছিলেন। মোড়টি থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-সিরাজগঞ্জ সড়কের যত দূর চোখ যায়, ছিল শুধু এ চিত্র।

নরসিংদীর মনোহরদী থেকে ষাটোর্ধ্ব মা রোকসানাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন রোবিনা আক্তার। সঙ্গে ৮ বছরের শিশু রফিকুল। তাদের গন্তব্য বিমানবন্দরের আশকোনা এলাকা। চান্দনা চৌরাস্তা থেকে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে আসেন টঙ্গী সেতু পর্যন্ত। কিন্তু এখান থেকে আর কোনো গাড়ি পাচ্ছিলেন না। তাই তারা হেঁটেই রওনা দেন।

আবদুল্লাহপুর মোড় থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ধরে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে পুরো সড়কেই দেখা যায় হাজারো খেটে খাওয়া মানুষের ভোগান্তির চিত্র। সড়কটির দুই পাশ ধরেই হাঁটছিলেন তাঁরা। তাঁদের প্রায় সবাই বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিক।

এদিকে শ্রমিকেরা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকার পথ ধরায় গতকাল টাঙ্গাইলের সড়কের কোথাও কোথাও যানজটের সৃষ্টি হয়। সকালে দু-একটি করে বাস চললেও বেলা ১১টার পর থেকে বাসের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এতে বেলা তিনটার দিকে মির্জাপুরের গোড়াই এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের উভয় পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।

গাজীপুরের চৌরাস্তাগামী পিকআপ ভ্যানের যাত্রী রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের কপালের দুঃখ আর গেল না। বাড়ি থিক্যা বাইরিয়া বাস পাই না। কামও করণ লাগব। উঠলাম পিকআপে। অহন আবার যানজট। হায়রে কপাল।’

সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শ্রমিকদের ঢল নামে। মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ট্রাক, পিকভ্যানে করে গন্তব্যের উদ্দেশে ছোটেন শ্রমিকেরা।

গণপরিবহন চলার অনুমতি

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল রাত থেকে শ্রমিকদের জন্য বাস ও লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রাতে প্রথম আলোকে জানান, রোববার পর্যন্ত সারা দেশ থেকে শ্রমিকদের ঢাকা নিয়ে আসার জন্য বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

একই সময় বিআইডব্লিউটিএর জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, শ্রমিকদের আনার জন্য শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সারা দেশে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পরে সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।