নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মেঘনা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর জেলেরা হতদরিদ্র। জীবিকার প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় তাঁদের। তবে জেলেদের কষ্টের আয়ের প্রায় সবটাই চলে যায় দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোনারগাঁয়ের নুনেরটেক, সাতভাইয়াপাড়া, রামগঞ্জ, আনন্দবাজার; আড়াইহাজার উপজেলার কালাপাহাড়িয়া, খালিয়ারচর, হাজিরটেক; মেঘনা উপজেলার মৈশারচর, বড়ইকান্দি ও নলচর মেঘনার তীরে অবস্থিত। এসব গ্রামের ৮০ শতাংশ লোক নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জেলেরা সারা দিন ও রাতে মাছ ধরে সোনারগাঁয়ের বৈদ্যেরবাজার ফিশারিঘাটে বিক্রি করেন। কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলেরা হতদরিদ্র। মাছ ধরার জাল, নৌকা ও ট্রলার কেনার জন্য বৈদ্যেরবাজার ফিশারিঘাটের আড়তদার ও মহাজনদের কাছ থেকে প্রতিবছর ঋণ নেন জেলেরা। স্থানীয় ব্যক্তিরা একে দাদন ব্যবসা বলেন। জেলেরা যে পরিমাণ টাকা দাদন নেন, প্রতিদিন সেই টাকার ১৫ শতাংশ দাদন ব্যবসায়ীদের দিতে হয়। পাশাপাশি জেলেদের নিজ নিজ দাদন ব্যবসায়ীর আড়তে এনে মৌখিক নিলামে মাছ বিক্রি করতে হয়। আর নিলামে ওঠার আগেই জেলেদের মজুত মাছের এক-দশমাংশ আড়তদার সরিয়ে রাখেন। সরিয়ে ফেলা মাছ পরে আবার নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়।
গতকাল শনিবার সকালে বৈদ্যেরবাজার ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ নৌকায় জেলেরা মাছ নিয়ে নদীতীরে আসছেন। জেলেরা নিজ নিজ দাদন ব্যবসায়ীর আড়তে এনে মাছ তুলছেন। মাছ আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে আড়তের লোকজন নির্দিষ্ট পরিমাণ মাছ নিজেদের আয়ত্তে নিচ্ছেন। এরপর বাকি মাছের নিলাম করছেন। নিলামে তোলার পর মোট টাকা থেকে ১৫ টাকা হারে দৈনিক সুদ কেটে নেওয়া হচ্ছে।
কালাপাহাড়িয়া গ্রামের জেলে নুরু মিয়া বলেন, আড়তদারেরা প্রথমে মাছ, এরপর নগদ টাকা কেটে নেন। এভাবে মাছ বিক্রির অর্ধেক টাকা তাঁদের পকেটে চলে যায়। এ কারণে দিনরাত পরিশ্রম করেও তাঁদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে।
বৈদ্যেরবাজার ফিশারিঘাটের আড়তদার নোয়াব মিয়া বলেন, ‘মেঘনার তীরের গ্রামগুলোতে তিন শতাধিক জেলে আমাদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে মাছ ধরেন। আমরা কাউকে জোর করে দাদনের টাকা দিই না। জেলেরা গরিব। নিজেদের প্রয়োজনে আমাদের কাছে এসে তাঁরা টাকা নেন। সারা দেশের মতো একই নিয়মে আমরা জেলেদের কাছ থেকে মাছ ও টাকা আদায় করি।’
নুনেরটেক ও কালাপাহাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অনেক জেলে ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা দুপুরের খাওয়া শেষে ঘুমাচ্ছেন। আবার অনেকে ছোট মাছ ধরার জাল বুনছেন। কেউ কেউ নদীতে মাছ ধরতে গেছেন। নুনেরটেক গ্রামের জেলে কাশেম আলী বলেন, দাদন ব্যবসার কবলে পড়ে এ গ্রামের জেলেরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। আর প্রতিদিন মাছ নিয়ে আড়তে না গেলে আড়তদারদের লোকজন বাড়িতে এসে জেলেদের মারধর করেন। কালাপাহাড়িয়া গ্রামের জেলে ইজ্জত আলী বলেন, ‘সরকারই পারে সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে। নতুবা আমাদের অভাব কোনো দিন শেষ হবে না।’
সোনারগাঁ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মমিনুল হক বলেন, ‘আমরা একাধিকবার চেষ্টা করেও জেলেদের দাদন ব্যবসা থেকে দূরে রাখতে পারিনি। সরকারিভাবে জেলেদের জন্য সুদবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করা হলে হয়তো দাদন ব্যবসা বন্ধ হবে।’