পদ্মা সেতু দিয়ে শুধু মানুষ পারাপার হবে না। এই সেতু ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শুরু হয়েছে শিল্পায়নের তোড়জোড়। ইতিমধ্যে সরকার নানা ধরনের অবকাঠামো স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতও বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান হবে, যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সহজ যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় অতীতে দক্ষিণাঞ্চলে বড় কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পর ওপারে শিল্পায়নের উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও শিগগিরই কাজ শুরু হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কারণে পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের গুরুত্ব বেড়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম, মোংলা ও মাতারবাড়ীর পর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার। এই বন্দর চালু করতে ২০২০ সালে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি কাজ শুরু করে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে সাগর থেকে জেটি পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং, টার্মিনাল-জেটি নির্মাণ, ইয়ার্ড নির্মাণ, বন্দর থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সংযোগ সড়ক নির্মাণ। এসব প্রকল্পে সরকারের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। আগামী বছর পায়রা বন্দর চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব সোহরাব হোসেন (উপসচিব) প্রথম আলোকে বলেন, পায়রা বন্দরের টার্মিনাল-জেটি নির্মাণ, ইয়ার্ড নির্মাণ, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে পায়রা বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে।
দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা পবন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও এগিয়ে আসবে। পর্যটন বিকাশের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দুই বছর আগে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ জন্য শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরে ৬০ একর করে মোট ১২০ একর জমি অধিগ্রহণ ও ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ। সেখানে ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড হবে। এখন দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। এতে প্রথম পর্যায়ের কাজে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৩০৭ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁতপল্লির কাজ শেষ হলে সেখানে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তাঁতিদের দক্ষতা বাড়বে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে তাঁতবস্ত্রের বাজার সৃষ্টিতে সরকার উদ্যোগ নেবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য বলছে, নদীর দুই পারে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আবার কোনোটির কাজ শেষের দিকে। মাদারীপুরের শিবচরে ৩৫০ একর জায়গায় একটি শিল্পপার্ক করবে বিসিক। যশোরে আরেকটি শিল্পপার্ক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই দুটি প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু ঘিরে নদীর এপারে মুন্সিগঞ্জে বিসিকের চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এগুলো হচ্ছে প্লাস্টিক শিল্পকারখানা, রাসায়নিক শিল্পকারখানা, মুদ্রণশিল্প ও এপিআই শিল্পপার্ক।
বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক রাশেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে বিসিক বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ফরিদপুরে ৫০০ একর, খুলনায় ৫০০ একর, নড়াইলে ২০০ একর এবং মাগুরায় ২০০ একর জায়গায় শিল্পপার্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) তিন বছর আগে বাগেরহাটের মোংলায় ২০৫ একর জায়গায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ শুরু করে। ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ। মোংলায় ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০৫ একর জায়গায় এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ২০০ একর জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে বেজা।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনা, সাতক্ষীরা ও মাগুরায় আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা রয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরায় আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের নতুন দিক উন্মোচিত হবে।’
এ ছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় বন্দরে একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
পদ্মা সেতু চালুর পর সাতক্ষীরার ভোমরা ও যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন ও যাত্রী যাতায়াত কয়েক গুণ বাড়তে পারে। এ জন্য ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দরকে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। এ প্রকল্পের আওতায় ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দরে আন্তর্জাতিক যাত্রী টার্মিনাল হবে। এ ছাড়া ওয়্যারহাউস, বাস ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের কথা রয়েছে।