কর্মস্থল টাঙ্গাইলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে বাসে উঠে রাতভর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন চিকিৎসক মো. শফিকুল ইসলাম। পরদিন ডাকাতের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকার দুই থানায় দৌড়াদৌড়ি করেও মামলা করতে পারেননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে ১০ দিন পর গতকাল রোববার উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করতে পেরেছেন ভুক্তভোগী এই চিকিৎসক। গতকালই ডাকাত দলের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ডাকাত ধরা নিয়ে আজ সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তারের কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, শফিকুল কেন মামলা করতে পারলেন না? জবাবে পুলিশের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কাজটা ঠিক হয়নি। ডাকাতি মামলায় কাজ করতে হয় বেশি, সে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যায়।
শুধু এই ডাকাতির ঘটনাই নয়, এর আগেও নানা সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা না নেওয়ার অভিযোগ এসেছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। গত মাসে গাড়ির ধাক্কায় বাবা গুরুতর আহত হওয়ার পর মামলা করতে পারছিলেন না পুলিশের সার্জেন্ট মহুয়া হাজং। অথচ অভিযুক্ত গাড়িচালক আইসিইউতে চিকিৎসাধীন তাঁর বাবা মনোরঞ্জন হাজংকে দায়ী করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার মুখে ১৪ দিন পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে কর্মরত এই পুলিশ সদস্যের মামলা নেয় বনানী থানা–পুলিশ।
মহুয়া হাজংয়ের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আলোচনায় আসে প্রায় এক দশক আগে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ গিয়ে স্বজনদের নতুন করে জেরা করার বিষয়টি। বলা হচ্ছে, থানায় তাঁরা যেসব সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন, সেগুলোর সঙ্গে সভা–সমাবেশ বা গণমাধ্যমে তাঁদের দেওয়া বক্তব্যের মিল নেই। অপর দিকে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, স্বজন গুম হওয়ার পর তাঁরা মামলা করতে থানায় থানায় ঘুরেছেন। পুলিশ মামলা নেয়নি।
গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে মামলা না নেওয়াকে আইনের ব্যত্যয় হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ধর্তব্য ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ না নেওয়ার ক্ষমতা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নেই। আর একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর মতে, এসব অভিযোগ না নেওয়াটা ‘বড় ধরনের অন্যায়’ হয়েছে।
পুলিশের গবেষণায়ও মামলা করতে থানায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের হেনস্তার শিকার হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। পুলিশ স্টাফ কলেজের গবেষণা ‘কনভিকশন অব রেপ কেসেস: আ স্টাডি অন মেট্রোপলিটান সিটিজ অব বাংলাদেশ’-এ বলা হয়েছে, ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু থানায় হেনস্তার শিকার হন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া ৫৭৫টি মামলার এজাহার, ধর্ষণের শিকার ১৭৫ জন নারী ও শিশু এবং ১৯১ জন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ রুলস অব বেঙ্গল (পিআরবি) এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ধর্তব্য অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য। কোনো অপরাধের বিচার নিশ্চিতের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করা হয়, আর পুলিশ রুলস অব বেঙ্গল (পিআরবি)-কে পুলিশের বাইবেল হিসেবে গণ্য করা হয়।
মামলা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে বলেই যেকোনো থানার বাইরে টাঙানো সিটিজেনস চার্টারে কীভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে, পুলিশের ভূমিকা কী হবে এবং থানা অভিযোগ নিতে না চাইলে ভুক্তভোগী কী প্রতিকার পেতে পারেন, সে সম্পর্কে বলা আছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যৌথভাবে ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ পুলিশ–জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিসের সেবা প্রোফাইল’ নামে একটি বই প্রকাশ করে। সে বইয়েও এ বিষয়ে বলা আছে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাওসার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াসমিন সুলতানা বনাম বাংলাদেশ (৫৪ ডি.এল.আর. পৃ. ২৬৯) মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের পর্যবেক্ষণ ছিল, ধর্তব্য অপরাধের তথ্য পেলে এফআইআর দায়ের ও তদন্ত শুরু করতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আইনগতভাবে বাধ্য। একইভাবে বাংলাদেশ বনাম ত্যান খেং হক মামলায় আপিল বিভাগ বলেছেন, ধর্তব্য অপরাধের তথ্য পেলে সেই তথ্যের ভিত্তিতে এজাহার নেওয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
এই আইনজীবী বলেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় কীভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হবে, তা–ও বলা আছে। যেমন, ‘ধর্তব্য অপরাধের’ তথ্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দিলে তিনি তা লিখে তথ্যদাতার সই নেবেন। কী লিখেছেন, তা তথ্যদাতাকে পড়ে শোনাবেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং নির্দিষ্ট বইয়ে সংরক্ষণ করবেন। তথ্যটি যখন নির্ধারিত ফরমে লিখে লিপিবদ্ধ করা হবে, তখন সেটাকে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআর বলা হবে।
আইন অনুযায়ী, ধর্তব্য অপরাধ হলে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এখানে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার ‘স্বীয় বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত’ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।
জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে এ প্রসঙ্গে বলা আছে। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দায়েরের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। টেলিফোনেও কেউ যদি ধর্তব্য অপরাধের অভিযোগ করেন এবং পুলিশ কর্মকর্তা যদি তা লিপিবদ্ধ করেন, তাহলে তা–ও প্রাথমিক তথ্যবিবরণী হিসেবে গণ্য করে পুলিশ তদন্ত শুরু করতে পারে।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার নাঈম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ যা করে থাকে, তা হলো কেউ কোনো অভিযোগ করলে সত্যতা যাচাই করে নেয়। কখনো কখনো অভিযোগ যাচাইয়ের পর দেখা যায়, তা বানোয়াট ছিল। সে ক্ষেত্রে মামলা হলে অকারণে মানুষকে ভুগতে হতো।
কিন্তু ধর্তব্য অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধর্তব্য অপরাধ কোনগুলো, সে সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে লেখা আছে। সহজভাবে বলতে গেলে বড় ধরনের যেকোনো অপরাধ, যেমন চুরি–ডাকাতি–ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ—এসবই ধর্তব্য অপরাধ।
মামলা নেওয়া বা না নেওয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বিবেচনার ওপর নির্ভর করে কি না, জানতে চাইলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এর কোনো সুযোগই নেই। এমন কোনো সুযোগ তৈরি করতে হলে নতুন করে সংসদে আইন পাস করতে হবে।’
পুলিশ রেগুলেশন্স বেঙ্গল-১৯৪৩ (পিআরবি)-এর ২৪৪ নম্বর প্রবিধানে বলা হয়েছে, আপাতদৃষ্টে অপরাধকে সত্য মনে হোক বা মিথ্যা, অপরাধ গুরুতর হোক বা মামুলি—যদি অপরাধ ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, কোনো বিশেষ বা স্থানীয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘটে তাহলে অভিযোগ নিতে হবে পুলিশকে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ পিআরবি অনুসরণ করে থাকে।
থানার বাইরে টাঙানো সিটিজেনস চার্টারে বলা আছে, থানায় মামলা করতে আসা কোনো ব্যক্তির মামলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/দায়িত্বরত কর্মরত নথিভুক্ত করতে না চাইলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি প্রতিকার চাইতে পারেন।
ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সহকারী পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করতে পারবেন। তিনি যদি এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেন, তাহলে ভুক্তভোগী ব্যক্তি উপকমিশনারের কাছে যেতে পারবেন। তিনিও অভিযোগ না নিলে পুলিশ কমিশনার বা পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছেও অভিযোগ দেওয়া যাবে।
থানায় কাজ না হলে ভুক্তভোগীরা আদালতে অভিযোগ দিতে পারবেন।
দেশে গুমের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না। সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ না নেওয়াটা ‘জঘন্য অন্যায়’। সত্য হোক বা মিথ্যা থানাকে অভিযোগ নিতে হবে।
মহুয়া হাজংয়ের মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে থানা–পুলিশ যেটা করেছে, তার পেছনে কোনো যুক্তি নেই বলে মন্তব্য করেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, দেখা গেল অভিযুক্ত ব্যক্তির সাধারণ ডায়েরি থানা দ্রুতই গ্রহণ করেছে। কিন্তু ভুক্তভোগীর অভিযোগ নিতে গড়িমসি করল। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যত প্রভাবশালীই হন না কেন, থানাকে অভিযোগ নিতেই হবে। এই দেশে দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির সাজা হয়েছে। আইন সবার জন্য সমান।