বক্তারা বললেন, থাইরয়েড সমস্যার সমাধানে চিকিৎসকদের জন্য গাইডলাইন তৈরির পাশাপাশি গবেষণা ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
থাইরয়েড গ্রন্থির নানা সমস্যা হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের পরই এর অবস্থান। মূলত নারীরাই এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন। তবে বাংলাদেশে থাইরয়েড সমস্যায় কতজন ভুগছেন, তার কোনো জরিপ নেই। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দেশের পাঁচ কোটির বেশি মানুষ থাইরয়েডের কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছেন। তাঁদের মধ্যে তিন কোটি মানুষ সমস্যাটি সম্পর্কে জানেনই না।
এ প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য খাতে থাইরয়েড সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে আলাদা কর্মসূচি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি খাদ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। স্ক্রিনিং ব্যবস্থাপনাকে সহজলভ্য করতে হবে। চিকিৎসকদের জন্য গাইডলাইন তৈরির পাশাপাশি গবেষণা ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে থাইরয়েড টাস্কফোর্স বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘থাইরয়েড রোগ: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, ডায়াবেটিস যেভাবে আলোচনায় এসেছে, থাইরয়েড সমস্যার বিষয়টি সেভাবে আলোচনাতেও নেই। ফলে নীরবে এটি মানুষের ক্ষতি করেই যাচ্ছে। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল নুভিস্তা ফার্মা।
গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা জানান, মানুষের গলার সামনের দিকে প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থিটির নাম থাইরয়েড। মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, শারীরবৃত্তিক আর বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া করার জন্য এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত।
আলোচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, থাইরয়েড ‘রহস্যজনক’ হরমোন হিসেবে পরিচিত। এ পর্যন্ত থাইরয়েড সমস্যা নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি। লালমনিরহাটের দরিদ্র মানুষদের ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশের গলগণ্ড পাওয়া গেছে, যার মধ্যে আবার নারীদের সংখ্যা বেশি। থাইরয়েড হরমোনের কমবেশির জন্য শরীরের প্রায় সব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের মানুষ যে আয়োডিন পাচ্ছে, তার মাত্রাও পরিমাপ করতে হবে।
অধ্যাপক রোবেদ আমিন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে কমিউনিটির মানুষকে যুক্ত করা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকেও যাতে থাইরয়েডের স্ক্রিনিং হয়, সে ধরনের ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া এ বিষয়ে কিছু কিছু চিকিৎসক একধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন, তাই চিকিৎসকদের জন্যও একটি গাইডলাইন তৈরি জরুরি বলে মত দেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি এবং বারডেম একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন ছোট গবেষণার তথ্য বলছে, থাইরয়েড সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মাতৃগর্ভ থেকেই জটিলতার শুরু। সুষ্ঠু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির নবনির্বাচিত সভাপতি, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন, দেশের মানুষ নির্দিষ্ট মাত্রায় আয়োডিন পাচ্ছে কি না, কোন জায়গায় আয়োডিনের ঘাটতি বেশি, এসব নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। অন্ধকারে ঢিল না ছুড়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান নারীদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগেই চিকিৎসকের কাছে এসে থাইরয়েড পরীক্ষা করানোর আহ্বান জানান। আর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগে পরীক্ষা করানো সম্ভব না হলেও অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শে গর্ভধারণের পুরো সময় ফলোআপে থাকতে হবে।
মেধাবী মানুষের সমাজ নিশ্চিত করতে চাইলে মানুষের শরীরে সঠিক মাত্রায় থাইরয়েড থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহজাদা সেলিম। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত। এ দেশটিতেও ৬০ শতাংশ মানুষের থাইরয়েড সমস্যা শনাক্তের বাইরেই রয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়।
বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান চিকিৎসক সুরাইয়া বেগম বলেন, মায়ের থাইরয়েড সমস্যায় মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম হয়। তাই অন্তঃসত্ত্বা নারীর পাশাপাশি নবজাতকদেরও স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সহসভাপতি, বারডেম হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারিয়া আফসানা বলেন, থাইরয়েড সমস্যায় গলগণ্ড, ওজন বেড়ে যাওয়া, শরীর ফুলে যাওয়া, নারীদের অনিয়মিত মাসিক, বন্ধ্যত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, অনেক বেশি ক্ষুধা লাগা, বেশি খাওয়ার পরও শরীরের ওজন না বাড়া, শিশুদের উচ্চতা না বাড়া, বুদ্ধির বিকাশ না হওয়াসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। তিনি জানান, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা হলে থাইরয়েড সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সায়েন্টিফিক সম্পাদক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম সাইফুদ্দিন বলেন, থাইরয়েড হচ্ছে তরকারিতে লবণের মতো, বেশি বা কম দুটোই সমস্যার সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, বর্তমানে জেলা পর্যায়ে থাইরয়েড পরীক্ষার সুযোগ আছে। রোগী কী সমস্যা নিয়ে এসেছেন, চিকিৎসকেরা তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলেই রোগীর মূল সমস্যা চিহ্নিত হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন নুভিস্তা ফার্মার সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) সালেহা বেগম। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।