দেশে ক্রমেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের দুশ্চিন্তা অন্তহীন। ঘরে ক্ষুধা, বাইরে করোনা। মানুষ এখন যাবে কোথায়? ক্ষুধার জ্বালা করোনার জ্বালার চেয়েও ভয়ংকর। তাই দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ-মিছিল হচ্ছে। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সরফদি গ্রামে খাদ্যের দাবিতে সড়কে মানুষের শুয়ে থাকার ঘটনাও ঘটেছে।
অসহায় মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ত্রাণ বিতরণে হয়েছে দুর্নীতি। দেশের বিভিন্ন স্থানে মজুত রাখা সরকারি চাল জব্দ করার ঘটনাও নেহাত কম নয়। আবার যেখানে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, সেখানে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কোনোভাবেই সামাজিক দূরত্ব ঠিক রাখা যাচ্ছে না। ফলে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে।
করোনার এমন সংকটকালে অসহায় মানুষকে সহায়তার পুরোনো পদ্ধতি পাল্টানোর সময় এসেছে। শুধু ত্রাণ দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানো কঠিন হবে। এ জন্য চায় নগদ টাকা। দেশে চার কোটির বেশি পরিবার আছে। এর মধ্যে অন্তত দুই কোটি দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারকে কয়েক মাসের জন্য ভাতার আওতায় আনতে হবে।
চার সদস্যের পরিবারের ভাতা হতে পারে ছয় হাজার টাকা। আর ছয় সদস্যের পরিবারের ভাতা আট হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশি সদস্য থাকলে সর্বোচ্চ ভাতা ১০ হাজার টাকা হতে পারে। যাতে এই দুর্যোগের মুহূর্তে কোনোমতে খেয়েপরে বাঁচতে পারে মানুষ। দুই কোটি পরিবারকে গড়ে আট হাজার টাকা করে দিলে মাসে সরকারের ব্যয় দাঁড়ায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ‘করোনা তহবিল’ গঠন করতে হবে। দেশের শীর্ষ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ধনী শ্রেণির মানুষকে সেই তহবিলে টাকা দিতে হবে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতনের একটি অংশ বাধ্যতামূলক করোনা তহবিলে জমা নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের একটি অংশ করোনা তহবিলে হস্তান্তর করা যেতে পারে। এরপরও অর্থের জোগান না হলে বিদেশি সহায়তায় ঋণ নিতে হবে। ভাতার অর্থ দিতে হবে মোবাইল ফোনে। আর এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, রকেট, নগদের মতো প্রতিষ্ঠানকে চার্জমুক্ত টাকা উত্তোলনের সেবা দিতে বাধ্য করতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এত অল্প সময়ে গরিব পরিবারের তালিকা করা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রতিটি দরিদ্র পরিবারের খবর জানেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন নজরদারি করলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে প্রকৃত দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের তালিকা দ্রুত প্রস্তুত করা সম্ভব। ভাতার টাকা পৌঁছানো গেলে তাদের ঘরবন্দী রাখা অনেকটা সহজ হবে। তখন শহর, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। ক্ষুধা বা রোজগারের অজুহাত দিয়ে কারও বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ থাকবে না। জরুরি খাদ্যদ্রব্য ক্রয় ছাড়া কাউকে আর বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া যাবে না।
অল্প সময়ের জন্য ত্রাণ দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানো যায়। কিন্তু দীর্ঘকালীন সংকট মোকাবিলায় নগদ অর্থের বিকল্প নেই। কেননা বাঁচার জন্য ত্রাণ ছাড়াও আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর দরকার হয়। হাতে টাকা না থাকলে সেই দরকার মেটানোর জন্য মানুষ চুরি বা ছিনতাইয়ের আশ্রয় নিতে পারে। এরপরও যদি আশপাশের বিত্তবান ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ত্রাণ দিতে চায়, সে ক্ষেত্রে তা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিতে হবে। তবে মূল সহায়তা হওয়া জরুরি সরকারি উদ্যোগে নগদ টাকার মাধ্যমে।
সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সব পেশার মানুষকে মানবিকভাবে এগিয়ে আসা জরুরি। সরকারও এগিয়ে এসে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে ব্যাংকারদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। করোনার রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের প্রণোদনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের কথা না হয় বাদই থাকল। করোনাকালে দায়িত্বরত সেনা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, গ্রাম পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, জরুরি বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসসংশ্লিষ্ট পেশার মানুষ বিশেষ প্রণোদনা কি আশা করতে পারেন না?