রেলে জ্বালানি খরচ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই খাতে বরাদ্দ করা অর্থের চেয়ে প্রতিবছরই বাড়তি খরচ করছে রেলওয়ে। ফলে রেলের কাছে ২৭৫ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে রাষ্ট্রীয় তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।
রেলের নথিপত্র এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চুরির কারণেই তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই রেলের। জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়ে রেলের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও নেই। নির্দিষ্টসংখ্যক বগি নিয়ে একটি ট্রেন চললে কী পরিমাণ তেল খরচ হয়, সেটার একটা হিসাব ধরে যুগের পর যুগ চলে যাচ্ছে।
বকেয়া পরিশোধ না করলে তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা তেল কোম্পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এ অবস্থায় গত ২৩ জানুয়ারি এই খাতে বাড়তি ২১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত এক দশকে জ্বালানি তেলের দাম যেমন বেড়েছে, আবার কমেছেও। সব মিলিয়ে একটা স্থিতাবস্থা বজায় ছিল। ফলে জ্বালানি খরচ এভাবে বেড়ে যাওয়ার খুব বেশি কারণ নেই। এর মূল কারণ তেল চুরি। পার্বতীপুর রেলওয়ের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা, বড় জংশন, বিভিন্ন ইঞ্জিন রাখার স্থানসহ ৫০-৬০টি স্থানে তেল চুরির ঘটনা বেশি হয়। আর মালবাহী ট্রেনগুলো দীর্ঘ সময় বিভিন্ন স্টেশনে থামিয়ে রাখা হয়। এসব ট্রেনেরও তেল চুরি হয়। অনেক সময় ডিপো থেকে তেল ইঞ্জিনে ভরার সময়ও চুরি হয়।
গত দুই বছরে র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পার্বতীপুর, খুলনা রেলস্টেশন, ভৈরববাজার রেলস্টেশন ও নাটোরে অভিযান চালিয়ে চুরির ঘটনা হাতেনাতে ধরেছে। ২০১৭ সালে রেলের এক তদন্তে তেল চুরির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের তথ্য বেরিয়ে আসে।
জানতে চাইলে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) মো. জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রেল পরিচালনায় কী পরিমাণ জ্বালানি প্রয়োজন, তা ঠিক করা কঠিন। এ জন্য বাজেটে হয়তো কম অর্থায়ন হয়ে যায়। এ জন্য প্রতিবছরই কিছু কিছু বকেয়া জমে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাড়তি চাহিদা দেওয়া হয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ জ্বালানি খাতে বাড়তি বরাদ্দের কারণ হিসেবে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলেছে। ট্রেনে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বগি এবং পাওয়ার কারের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে রেলের সূত্র বলছে, ২০১৩ সালে সারা দেশে ৩৩৪টি ট্রেন চলাচল করত। বর্তমানে ট্রেন চলে ৩৫৪টি। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে ট্রেন বেড়েছে ২০টি। অন্যদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে রেলের বরাদ্দ ছিল ২৪৯ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয় ৪২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১৭৪ কোটি টাকা।
রেলের নথি অনুসারে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা—এই তিন তেল সরবরাহকারী কোম্পানি রেলের পশ্চিমাঞ্চলে বছরে ৯০ লাখ লিটার তেল সরবরাহ করে থাকে। পূর্বাঞ্চলে তেল সরবরাহ করে ৯০ লাখ ৪০ হাজার লিটার। দুই অঞ্চলে বছরে তেল সরবরাহ করা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ ৪০ হাজার লিটার। রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, তেল চুরির ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাতেনাতে ধরে ফেললে তদন্ত হয়, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু রেল নিজে থেকে তেল চুরি ধরে ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন ঘটনা নেই।
গত বছর অক্টোবরে খুলনা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে থাকা ট্রেনে তেল সরবরাহের পাইপের সঙ্গে অন্য পাইপ জুড়ে দিয়ে চুরি করা হচ্ছিল তেল। আর সেই তেল নেওয়া হচ্ছিল ওই স্টেশনের প্রায় ২০০ মিটার দূরে সীমানা ঘেঁষে গড়ে ওঠা একটি তেল বিক্রির দোকানে। র্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে ওই তেল চুরির সময় দুজনকে হাতেনাতে আটক করে। এ সময় ১৭ ড্রাম তেলও জব্দ করা হয়।
গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি নাটোরের আবদুলপুর রেলওয়ে জংশনে রেলের তেল চুরির সময় ১ হাজার ৩৮০ লিটার তেলসহ ৫ জনকে আটক করে র্যাব।
২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীনিধি স্টেশনের কাছে ভোরে ট্রেন থামিয়ে তেল চুরির ঘটনা ঘটে। পরে চুরি যাওয়া ৩০০ লিটার তেল উদ্ধারও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চালককে গ্রেপ্তার করা হয়।
এই বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তেল চুরি হয়, এটা ঠিক আছে। এটা রোধে তাঁরা নতুন একটি যন্ত্র যুক্ত করা শুরু করেছেন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ট্রেন চলার সঙ্গে সঙ্গে যৌক্তিকভাবে তেল কমে যাওয়ার হিসাব পাওয়া যায়। অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে বোঝা যাবে যে এতে চুরি বা অন্য সমস্যা আছে। তখন ধরা যাবে। ইতিমধ্যে কিছু ইঞ্জিনে এই ব্যবস্থা চালু করে সুফল পাওয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে সব ইঞ্জিনেই এই যন্ত্র লাগানো হবে।