তেঁতুলতলা মাঠে থানা হলে তা হবে জবরদস্তির প্রতীক: মোবাশ্বের হোসেন

মোবাশ্বের হোসেন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মাঠ রক্ষাসহ নানা নাগরিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থাকেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন নির্মাণ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক এবং স্থানীয় এক নারীকে তাঁর সন্তানসহ আটকে রাখার ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রশ্ন

প্রথম আলো: তেঁতুলতলা মাঠে নির্মাণকাজ বন্ধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছেলেসহ সৈয়দা রত্না থানায় আটক হলেন। ১২ ঘণ্টার বেশি আটকে রাখা হলো তাঁদের। প্রতিবাদের মুখে মধ্যরাতে তাঁদের ছাড়া হলো। এ ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মোবাশ্বের হোসেন: আমি মনে করি সরকারকে বিব্রত করার জন্যই এই বেআইনি কাজটি করা হয়েছে। এ ঘটনা চরম নিন্দনীয়। একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে হাজতে নেওয়া হয়েছে। কাউকেই ওয়ারেন্ট ছাড়া হাজতে নেওয়া যায় না। এর পাশাপাশি যে ঘটনা ঘটেছে, ওই থানাতে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি থানা কর্মকর্তাবিহীন কীভাবে চলে? আর তাঁরা কারও ফোন ধরেননি। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা যদি সবচেয়ে বড় আইন ভঙ্গকারী হন, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশে উন্মুক্ত জলাশয় ও খেলার মাঠ আইন আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিটি বক্তব্যেই উন্মুক্ত জলাশয় ও খেলার মাঠ রক্ষার কথা বলেন। কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কয়েক দিন আগে নিউমার্কেটের ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির সমালোচনা হয়েছে। সংঘাতে দুজনের প্রাণ গেছে। এরপর আবার তেঁতুলতলা মাঠের ঘটনা ঘটল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা যে বাহিনীর কাজ, তারা নাগরিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। এসব ঘটনা বারবার ঘটছে কেন?

মোবাশ্বের হোসেন: পুলিশ বাহিনীর মধ্যে খন্দকার মোশতাকের চেলাচামুন্ডারা ঢুকে গেছে। নিউমার্কেটের ঘটনা তো তাদের গাফিলতির একটি উদাহরণ। এরও আগে আপনারা দেখেছেন টিপ পরার জন্য এক নারীকে হেনস্তা করা হয়েছে। পুলিশের ভেতরে এরা কারা? এরা সরকারের অর্জনগুলো নষ্ট করে দিতে চায়। সামনে নির্বাচন, তাই এরা আরও সক্রিয় হচ্ছে। এর আগে এই তেঁতুলতলা মাঠে খেলার অপরাধে স্থানীয় কয়েক শিশুকে কানধরে ওঠবস করায় পুলিশ। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এবারের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা ন্যক্কারজনক। পুলিশ বলে তারা জনগণের বন্ধু। কিন্তু তেঁতুলতলা মাঠে যে ঘটনা ঘটল, এই কি তাদের বন্ধুত্বের নমুনা? আটকের ঘটনার পর আমাদের একজনের তরফ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি এই আটকের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তাঁকে জানানো হয়নি। বোঝা যাচ্ছে এই চক্র কতটা শক্তিশালী।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: রাজধানীতে উন্মুক্ত নাগরিক পরিসর নাই হয়ে যাচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানে স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। শিশুদের জন্য কোনো খোলা জায়গা রাখার কারও কোনো দায়িত্ব নেই বলে মনে হয়। সিটি করপোরেশনগুলো এ ক্ষেত্রে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে?

মোবাশ্বের হোসেন: নগরের শিশুদের জন্য খোলা মাঠের ব্যবস্থা করা সিটি করপোরেশনগুলোর দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে খোলা মাঠ সব গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। একটি তথ্য জানাই, এই যে তেঁতুলতলা মাঠ এটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০১৬-৩৫ সালের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) মাঠ হিসেবে চিহ্নিত আছে। এখন এখানে মাঠ করতে গিয়ে জনগণের বন্ধু পুলিশ সরকারি সিদ্ধান্তেরই বিরোধিতা করছে। এ এলাকার সাংসদ, সিটি করপোরেশনের মেয়র বা স্থানীয় কাউন্সিলরদের তো এ মাঠ রক্ষার জন্য এগিয়ে আসা উচিত ছিল। বাস্তবে তা হয়নি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: তেঁতুলতলা মাঠে স্থাপনা তৈরির কোনো কোনো বিকল্প ছিল না? এ ক্ষেত্রে কী করা বাঞ্ছনীয় ছিল বলে আপনার মনে হয়?

মোবাশ্বের হোসেন: এই তেঁতুলতলা মাঠ থেকে খানিকটা দূরের ধানমন্ডির মাঠ খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের রায় আছে। কিন্তু বাস্তবে সেখানে কী হচ্ছে? নিরাপত্তা প্রহরী রেখে মাঠ ঘিরে রাখা হয়েছে। মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। ইচ্ছেমতো এর ব্যবহার হচ্ছে। পুলিশ তো রাষ্ট্রীয় আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা দেখবে। কিন্তু সেই মাঠ উদ্ধার না করে তারা নতুন করে মাঠ দখল করছে। স্থানীয় পুলিশ এবং সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল, মাঠ ছাড়া সেখানে থানা কেন দরকার, তা স্থানীয় মানুষকে বোঝানো। থানা তো মানুষের জন্য। তারা থানা চাইছে না। এখন যদি জোর করে এখানে থানা নির্মাণ করা হয়, তবে সেটি জবরদস্তির একটি প্রতীক হিসেবে থেকে যাবে। স্থানীয় মানুষ একে তাদের ওপর নিপীড়নের একটি প্রতীক হিসেবে দেখবে। মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, তারা এভাবে একটি নির্দয়তার উদাহরণ সৃষ্টি করবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিভিন্ন নাগরিক ইস্যুতে ঢাকায় নাগরিক আন্দোলন কতটুকু জোরদার হচ্ছে? শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গঠনের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?

মোবাশ্বের হোসেন: সেই স্বাধীনতার আগে থেকে এখন পর্যন্ত নাগরিক আন্দোলনে একটি বিষয় দেখা যায়, তা হলো মানুষ একটি আন্দোলন শুরু করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারে না। এর নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। আগে এ নগরে প্রতিবেশীর প্রতি সহমর্মিতার একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু আর্থিক উন্নতি অনেক নেতিবাচক দিক সৃষ্টি করে, এখানেও তাই হয়েছে। সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেলে মানুষ তার প্রতিবেশীর প্রতি উন্নাসিক হয়ে যায়। এই প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালন না করা শুধু ঢাকা শহর নয়, বড় শহরগুলোতে সংক্রামক ব্যাধির মতো হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে পারে আমরা যদি আমাদের পরিবারের সন্তানদের খেলার মাঠ দিতে পারি। সেই মাঠে গিয়ে তারা পরস্পরের সঙ্গে মিশবে, ভাবের আদান–প্রদান হবে। সামাজিক সম্পর্কের সৃষ্টি হবে। একটা আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হবে। যেটা পরবর্তী সময়ে বিরাট সামাজিক সুবিধা দেবে।