গতকাল রাত আটটায় যখন কথা হচ্ছিল, তখনো তাঁরা ইমিগ্রেশন পার হতে পারেননি।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে জিতুমির শহরের দূরত্ব ১৬৫ কিলোমিটার। সেখানকার জিতুমির পলিটেকনিক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়েন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সোহেল রানা, ইয়াছিন আরাফাত, মুনতাকিমুন আন্নি ও সাদিকুর রহমান। বৃহস্পতিবার রাশিয়ার হামলার পর তরুণ এই শিক্ষার্থীরা ইউক্রেন ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু উপায় কী? বিষয়টি অনেকটা সহজ হলো যখন পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ছাড়াই সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়ার বিষয়টি জানাল। এরপর আর দেরি করেননি তাঁরা। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দুপুরে একটি গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। লক্ষ্য ৬৫০ কিলোমিটার দূরের লিভিভ শহর। পোল্যান্ড সীমান্তলাগায়ো শহর এটি। অন্য সময় জিতুমির থেকে লিভিভের জনপ্রতি ভাড়া ৬৫০ রিবনা। সুযোগ বুঝে তাঁদের চারজনের কাছ থেকে চালক নিলেন সাড়ে ৮ হাজার রিবনা। যুদ্ধের বাজার, প্রাণভয়—টাকার হিসাব আর করেননি কেউ। জিতুমির থেকে লিভিভের পথ তেমন কষ্টদায়ক হয়নি। দুর্ভোগ শুরু হলো এরপর থেকেই।
এক কর্মকর্তাকে এখানকার সময় ভোর চারটার দিকে ফোন করেছিলাম। তিনি একটুও বিরক্ত হননি। যতবার ফোন করেছি, কেউ বিরক্ত হননি। এটা ভোলার মতো নয়।সোহেল রানা, ইউক্রেনের জিতুমির পলিটেকনিক স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র
এবার কারকোভেট সীমান্তের দিকে যাওয়ার জন্য তাঁরা আবার একটি গাড়ি ভাড়া করেন। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর গাড়ির দীর্ঘ সারি। তরুণদের একজন সোহেল রানা গতকাল রোববার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর চোখ যায়, শুধু গাড়ি আর গাড়ি। সীমান্তমুখী হাজার হাজার মানুষ। গাড়ি ঘণ্টাখানেক রইল ঠায় দাঁড়িয়ে। শর্ত অনুযায়ী সীমান্তে পৌঁছে দিতে গাড়িওয়ালা বাধ্য। কিন্তু ভেবে দেখলাম, এভাবে শুধু কষ্টই বাড়বে। তাই হাঁটাপথ ধরলাম।’
প্রথমে আধা ঘণ্টা হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন চারজন। এরপরের সিদ্ধান্ত হলো, এক ঘণ্টা করে হাঁটবেন আর ১৫ থেকে ৩০ মিনিট বিশ্রাম। এভাবে চলছিল। প্রত্যেকের কাছে দুটো করে লাগেজ। হাঁটতে গিয়ে কোনোটি ছিঁড়ে গেল। সঙ্গে আনা শুকনো খাবারই তখন ভরসা। তীব্র শীতে এভাবে হাঁটা হলো ৪৫ কিলোমিটার। আট ঘণ্টা পর পৌঁছানো গেল সীমান্তে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল নতুন বিপত্তি।
পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস লিভিভের তিনটি সীমান্তের মধ্যে দুটো দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এই চারজন ভুল করে চলে গেছেন যেটির সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি করেনি সেটাতে। ক্লান্ত, অবসন্ন চার যুবার চোখে তখন অন্ধকার। উপায়ান্তর না দেখে পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তার নম্বর জোগাড় করে ফোন করলেন। তিনি সেই ফোন ধরে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। চুক্তিহীন এই সীমান্ত দিয়েই প্রবেশের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ইমিগ্রেশনে রাজ্যের ভিড়। গতকাল রাত আটটায় যখন কথা হচ্ছিল, তখনো তাঁরা ইমিগ্রেশন পার হতে পারেননি।
ইয়াছিন আরাফাত বলছিলেন, ‘ইমিগ্রেশনে ইউক্রেনের নাগরিকদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা যাঁরা ভিনদেশি, তাঁদের অপেক্ষা করতেই হবে বলে দিয়েছে।’
ইতিমধ্যে দুটি রাত পার করেছে দলটি। প্রথম দিন তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের ৭ ডিগ্রি নিচে, পরের রাতে ১ ডিগ্রি নিচে। কিন্তু এ সময় ইউক্রেনের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের আন্তরিক সহযোগিতা সেই কষ্ট অনেকটা ভুলিয়ে দিয়েছে। সীমান্তের একেবারে কাছে ইচ্ছেমতো বিনা পয়সায় খাবার মিলছে। কাঠের টুকরো জ্বালিয়ে দিয়ে ঠান্ডা নিবারণের ব্যবস্থা করেছে তারাই। এর সঙ্গে আছে বাংলাদেশের পোল্যান্ড দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা।
সোহেল রানা বললেন, ‘এক কর্মকর্তাকে এখানকার সময় ভোর চারটার দিকে ফোন করেছিলাম। তিনি একটুও বিরক্ত হননি। যতবার ফোন করেছি, কেউ বিরক্ত হননি। এটা ভোলার মতো নয়।’ ফোন করতে করতেই একজন ইমিগ্রেশনে ডাক পেলেন।