তিস্তা বিরোধিতা মমতার রাজনৈতিক চমক

বালুবেষ্টিত চরের মধ্যে সরু সরু খালের মতো বয়ে চলেছে তিস্তা। ডিমলার চরখড়িবাড়ি এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন শিশির মোড়ল
বালুবেষ্টিত চরের মধ্যে সরু সরু খালের মতো বয়ে চলেছে তিস্তা। ডিমলার চরখড়িবাড়ি এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন শিশির মোড়ল

মমতা যেসব নদীর পানি ভাগাভাগির কথা বলেছেন, তার সবই অভিন্ন নদী। এর পানি বাংলাদেশ এমনিতে পাচ্ছে। ফলে তাঁর বক্তব্য কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতাকে মমতার রাজনৈতিক চমক বলে বর্ণনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা বিধায়ক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, এটা মমতার রাজনৈতিক চমক। আন্তর্জাতিক একটি চুক্তি করতে গেলে যে মানসিকতার প্রয়োজন, সেটা মমতার নেই। তাঁর জন্য আজ বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি উৎসাহিত হচ্ছে, ভারতবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, সেটি বোঝার ক্ষমতা নেই তাঁর। তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় চুক্তিতেও মমতা প্রথম পর্যায়ে বাধা দিয়েছিলেন। তাই তোর্সার পানি দেওয়ার কথা বলে আরেক চমক দিলেন। অথচ তিস্তা চুক্তি করার জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু সেদিনও বাধা দিয়েছে তৃণমূল ও আসামের বিজেপি।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলের নেতা বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা তিস্তার জল দেব না, তোর্সার জল দেব বলেন, তাঁরা না বোঝেন উত্তরবঙ্গ, না বোঝেন নদীর প্রকৃতি। এটা রাজনৈতিক খেয়ালখুশির বিষয় নয়; আমাদের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। মমতার তিস্তার জল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তিকে আরও শক্তিশালী করবে। পশ্চিমবঙ্গের মৌলবাদী শক্তি উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা যাতে সন্তুষ্ট থাকে, সেই কথাই প্রতিধ্বনিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
আবার বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের সাবেক সভাপতি রাহুল সিনহা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমরা তিস্তা চুক্তিই দ্রুত বাস্তবায়ন করব। মোদিজি যে কথা বলেছেন, সেই লক্ষ্যেই আমরা তিস্তা সমস্যার সমাধান করব।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কিন্তু কেন এত বিরোধিতা করছেন মমতা? এ নিয়ে বিতর্কের অভাব নেই দেশজুড়ে। তবে পশ্চিমবঙ্গের কেউ কেউ মনে করছেন, মমতা চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে গোপনে এক ফয়সালা। মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস জড়িয়ে পড়েছে তিনটি বড় কেলেঙ্কারিতে। সারদা, রোজভ্যালি ও নারদ–কাণ্ড। আর এই কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন মমতার দলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, কলকাতার মেয়র ও নেতারা। সিবিআইয়ের হাতে এই মামলার তদন্তভার। আর সিবিআই রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এই কেলেঙ্কারি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মমতার এখন একটি মাত্র পথ খোলা। তা হলো কেন্দ্রে মোদি সরকারের সঙ্গে আপস করে চলা। কিন্তু মমতা সেই পথে এগোতে পারছেন না। কারণ, মমতার এখন ভোটের প্রধান অস্ত্র পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু ভোট। মমতা বিজেপির সঙ্গ দিলেই হারাবেন সংখ্যালঘু ভোট। আর তাতে পরবর্তী সময়ে মমতার ক্ষমতায় আসা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার বিজেপি সরকারের সঙ্গে আপসের পথে না গেলে বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় বিপদে পড়ে যাবেন তৃণমূলের নেতারা। তাই মমতা এখন দিশেহারা। এটা না হলে মমতা কিন্তু বিজেপির সঙ্গে মিশে যেতেন বলে বিরোধীদের দাবি। আগে দুই দফায় বিজেপির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন মমতা।
এত কিছুর পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন একটুও গলাতে পারেনি কেউ। ২৫ এপ্রিল বিকেলে কোচবিহারের চকচকায় এক দলীয় সমাবেশে বলেছেন, ‘তিস্তায় জল নেই। কোথা থেকে জল দেব? তবে বাংলাদেশ জল নিতে পারে তোর্সা, মানসাই ও সংকোশ নদী থেকে।’ অর্থাৎ আগের কথাই বলে চলেছেন মমতা।
তবে তাঁর দলেরই জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত বিধায়ক খগেশ্বর রায় হঠাৎ তিস্তা নিয়ে অন্য সুরে কথা বলেছেন। গত ১৯ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘কোনো নদীর জল আটকে রেখে কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ।’ তিনি আরও বলেন, তিস্তা ও তোর্সা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যা চলছে, তা আটকানো যাবে না।
এদিকে তিস্তার জল সম্পর্কে নদী বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে একটি সমাধান সূত্র বের করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের ওপর দায়িত্ব দেন। কথা ছিল ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে তিনি রাজ্য সরকারকে একটি রিপোর্ট দেবেন। তবে তিনি প্রতিবেদন দিয়েছেন কি না বা দিলেও কী দিয়েছেন, তা জানা যায়নি।
এদিকে রাজ্যের গণ্ডির সঙ্গে এবার নদীর বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে। গত ১৩ এপ্রিল এই ইঙ্গিত দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় জলসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সঞ্জীব বালিয়ান। বলেছেন, নদীর বিষয়টি কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ তালিকায় এলে নানা রাজ্যের নানা মত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। যদিও নদীকে যৌথ তালিকায় আনতে গেলে সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন হয়ে পড়বে।
তিস্তার তিন জেলার নেতারা কী বলছেন?
তিস্তার জল দেবেন না মমতা। ফলে মমতার দলের কোনো নেতাই চাইছেন না তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়া হোক। তৃণমূলের সব নেতারই এই এক কথা। তবে পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলা দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা, যার ওপর দিয়ে তিস্তা বয়ে গেছে সেখানকার বিজেপি ও বাম দলের নেতারা কথা বলেছেন অন্য সুরে। বিজেপির এই তিন জেলার সভাপতিরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মমতার চমককে পাত্তা দেন না। বলেছেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের। আমরা মোদিজির কথাই পুনর্ব্যক্ত করছি। তাই আমরা তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের পক্ষে মোদিজির পাশেই রয়েছি।’
আবার সিপিএমের জলপাইগুড়ির জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের দুদেশের মৈত্রী বন্ধন অক্ষুণ্ন থাকুক। দুই দেশের কৃষকেরা সেচের জল পান। আর এ নিয়ে অযথা কোনো বিড়ম্বনা আমরা দেখতে চাই না।’ কোচবিহারের সিপিএমের জেলা সম্পাদক তারিণী রায় প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমরা চাই দুই দেশের কল্যাণে এই চুক্তি হোক। দেখা হোক এ দেশের স্বার্থও।’
তিস্তা এলাকার কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের সাবেক বিধায়ক ও ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা পরেশ অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিস্তায় এখন পানি কম। ক্ষীণ ধারা চলছে। চর পড়েছে। আমরা চাই তিস্তা চুক্তি হোক। জল দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি নেই আমাদের। তবে আমাদের দাবি ২৫ বছর আগে গৃহীত তিস্তা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হোক।’
অন্যদিকে সাবেক ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের নেতা কোচবিহারের দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি না হওয়ার খেসারত দিতে হবে মমতাকে। দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে। কিন্তু মমতা তোর্সা নদীর জল দেওয়ার প্রস্তাব এনে রাজনৈতিক চমক দিয়েছেন। অথচ সবাই চাইছে তিস্তার জল নিয়ে সমাধান। তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে আমরা জনমত তৈরির জন্য মাঠে নেমে পড়ছি।’
আবার কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ বাংলাদেশ সীমান্তের ভোটবাড়ি এলাকার বাসিন্দা দধিরাম রায় বলেন, এই শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় জল নেই বললে চলে, যা আছে তা গজলডোবায় আটকে আছে।
নদী গবেষকেরা যা বললেন?
উত্তরবঙ্গের দুই নদী গবেষকের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁরা হলেন মানস মজুমদার ও অনিমেষ বসু। মানস মজুমদার জলপাইগুড়ি আর অনিমেষ বসু শিলিগুড়িতে থাকেন। তাঁরা দুজনেই এই তিস্তা নদী নিয়ে গবেষণা করছেন। অনিমেষ বসু হিমালয়ান ন্যাচার ও অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর। মানস মজুমদার সদস্য। তাঁরা ভারতবর্ষে ছুঁয়ে যাওয়া তিনটি আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে গবেষণা করছেন। এই নদী তিনটি হলো গঙ্গা, গন্ডোকি ও তিস্তা। সার্ক দেশ থেকে এই গবেষণার অর্থের জোগান দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের দায়িত্বে রয়েছে তিস্তা নদী। তিস্তা নদী কীভাবে এলাকার কৃষি, মানুষের জীবনযাপন, পরিবেশ, কৃষিশিল্প ও মৎস্যজীবীদের জীবনে প্রভাব ফেলছে, তার ওপরই তঁাদের মূল গবেষণা। তাঁরা অবশ্য এ কথা বলেছেন, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদী যেসব দেশের ওপর দিয়ে বইছে, সেসব দেশের এই নদীর জল পাওয়ার অধিকার আছে। তবে সেদিনের সেই তিস্তা এখন আর নেই। বিগতযৌবনা। পানি কমে গেছে। তবু আন্তর্জাতিক বিষয়টির দিক এবং আন্তর্জাতিক নদীর অধিকারের বিষয়টি ভেবে আমাদের এগোনো উচিত।