বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় তিনটি সেতু নির্মাণে চার বছর ধরে ঘুরেও বিদেশি অর্থায়ন জোগাড় করতে পারেনি সরকার। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জার্মান উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড), জাপান ও চীন সরকার—সবখানেই অর্থ চেয়ে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে নেওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বরিশাল ও পটুয়াখালীর পায়রা, আড়িয়াল খাঁ ও গলাচিপা বা লোহালিয়া নদীর ওপর তিনটি সেতু নির্মাণে ২০১২ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। এরপর প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১৭ শতাংশ সরকার বহন করবে এবং বাকিটা বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার এই তিন সেতু নির্মাণে গুরুত্ব দিলেও পুরোটা নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। এখনো বিদেশি অর্থ না পাওয়ার কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে এই তিনটি সেতু নির্মাণে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে অর্থায়ন চেয়ে বিশ্বব্যাংকের এদেশীয় পরিচালককে চিঠি দেয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। কিন্তু সংস্থাটি তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ওই মাসে চীন সরকারকে চিঠি দিয়ে অর্থায়নের অনুরোধ জানানো হয়। এই সেতুগুলো নির্মিত হলে বাংলাদেশ-চীন সেতু হিসেবে নামকরণেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় এই তিন সেতু নির্মাণে একটি সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) সই হয়। এরপর ইআরডি থেকে তিন দফা চিঠি দেওয়া হলেও আর এগোয়নি। সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করার অনুরোধ জানিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে জাপান সরকার ও এডিবিকে চিঠি দেয় ইআরডি। সর্বশেষ মার্চে জার্মানির আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জিআইজেডের সহায়তা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ইআরডির সচিব মনোয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিন সেতু নির্মাণে এখনো বিদেশি অর্থায়ন জোগাড় হয়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। একান্তই অর্থ না পাওয়া গেলে দেশীয় অর্থায়নের বিষয় বিবেচনা করা হবে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে বলে সরকার বাড়তি চাপ নিতে চাইছে না। অন্যদিকে বিদেশি অর্থায়নকারীরা দেখছে, এই তিন সেতুর স্থানে যানবাহনের চলাচল খুব বেশি নয়। এ জন্য তারা আগ্রহী হচ্ছে না। কিন্তু এই তিনটি সেতু নির্মাণে সরকারের গুরুত্বারোপের কারণ হচ্ছে, পদ্মা সেতু দুই বছরের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে। এ ছাড়া বর্তমানে পায়রা নদীর ওপর লেবুখালী সেতুর কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। পিরোজপুরে কচা নদীতে কুমিরমারা-বেকুটিয়া সেতুর কাজও শুরু হয়েছে। নির্মাণাধীন দুটি এবং প্রস্তাবিত তিনটি সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই সেতুগুলো পায়রা ও মোংলা বন্দরের সঙ্গেও সংযোগ তৈরি করবে।
পায়রা সেতু
কচুয়া - বেতাগী - পটুয়াখালী - লোহালিয়া - কালাইয়া সড়কের ওপর পায়রা নদীতে এই সেতু নির্মাণ করার কথা রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার। প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৮৬৮ কোটি টাকা। বর্তমানে ফেরি পারাপারের জন্য যানবাহন ও স্থানীয় মানুষকে দেড় ঘণ্টার বেশি অপেক্ষায় থাকতে হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে, ২০৪৭ সাল নাগাদ প্রতিদিন এই সেতু ব্যবহার করবে ৩৪ হাজার যানবাহন। এই সেতু নির্মিত হলে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের সঙ্গে বরগুনার বেতাগী উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হবে।
আড়িয়াল খাঁ সেতু
প্রস্তাবিত সেতুটি হওয়ার কথা রহমতপুর-বাবুগঞ্জ-মুলাদী-হিজলা সড়কে আড়িয়াল খাঁ নদে। এর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার। সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ৬০৯ কোটি টাকা। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সেতু দিয়ে ২০৪৭ সালে দৈনিক সাড়ে ২৩ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। প্রস্তাবিত সেতুটি বরিশাল সদরের সঙ্গে জেলার বাবুগঞ্জ, হিজলা ও মুলাদী উপজেলার সংযোগ তৈরি করবে। ফেরি পারাপারে এখন প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।
গলাচিপা/লোহালিয়া সেতু
লেবুখালী-দুমকি-বগা-দশমিনা-গলাচিপা-আমরাগাছি সড়কের ওপর হবে এই সেতু। দৈর্ঘ্য ১ দশমিক
৫৮ কিলোমিটার। প্রাথমিক ব্যয় প্রায় ৬১৬ কোটি টাকা। এই সেতু দশমিনা ও গলাচিপার সঙ্গে পটুয়াখালী জেলা ও বরিশালের সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করবে। ফেরির জন্য দেড় ঘণ্টা বা এর চেয়েও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। ২০৪৭ সাল নাগাদ দিনে ২০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে বলে সমীক্ষায় এসেছে।