জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয় স্যারের ক্লাসে। স্যার আমাদের পড়াতেন স্ট্রাকচার, ট্রাস। ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিসটাই আমার ভালো লাগত না। আমি ক্লাসের শেষ বেঞ্চ বসে ছবি আঁকতাম। এমনকি আমার দীর্ঘ কবিতা ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’র অনেক লাইন আমি ক্লাসে বসে লিখেছিলাম। আমি ইংরেজি, ইকোনমিকস, সোশিওলজি—এগুলোতে ভালো নম্বর পেতাম। যেমন স্ট্যাটিকসেও ভালো নম্বর পেয়েছিলাম। কিন্তু খুব খারাপ করতাম সেসব বিষয়ে, যেখানে মুখস্থ করতে হতো। যেমন ফর্মুলা। এমনকি সেন্ট্রয়েড বের করার ফর্মুলা আমার মনে থাকত না। কিন্তু যেহেতু ফর্মুলাটা কীভাবে ডেরাইভ করতে হয়, তা জানা ছিল, তাই পরীক্ষার খাতায় অঙ্ক না করে আমি ফরমুলা ড্রাইভ করার চেষ্টা করতাম।
আর অঙ্কে ভালো করতে পারতাম না। কারণ, তা করতে হলে প্রচুর প্রাকটিস করতে হয়। প্রাকটিস করার বান্দা তো আমি না। বিস্ময়করভাবে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের পরীক্ষায় আমি ৪০ নম্বরের মধ্যে ৩৯ পাই। এর কারণ এখন আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। স্যার পড়াতেন কম্পিউটারের মতো। প্রথম দশ মিনিটে তিনি বলতেন, গত ক্লাসে আমরা শিখেছি... এরপর কুড়ি মিনিটে তিনি নতুন পড়া পড়াতেন। শেষ দশ মিনিটে যা পড়িয়েছেন, তা আবার বলতেন এবং ছাত্রদের প্রশ্ন করতে বলতেন। ফলে ক্লাসেই স্যারের শেখানো পড়া আমরা শিখে ফেলতে পারতাম। পরীক্ষায় তিনি যা পড়িয়েছেন, তা-ই প্রশ্নে দিতেন। অনেক শিক্ষক মনে করেন, প্রশ্নপত্র কঠিন করা বাহাদুরি। যা পড়াইনি, তা থেকে প্রশ্ন করা আরও বাহাদুরি। পরীক্ষার হলে ছেলেরা একটু মাথা খাটাক। এর চেয়ে বড় বোকামি আর হয় না। পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীরা খুবই উদ্বিগ্ন থাকে, ওই সময়টা তাদের নতুন কোনো জটিল প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া অত্যন্ত নিষ্ঠুর রসিকতা। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার যা পড়িয়েছেন, তা-ই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দিতেন। ফলে আমার মতো বুয়েট-গর্দভ, যার স্কুল-কলেজের রেজাল্ট ভালো ছিল, সহজেই চল্লিশে ৩৯ পেয়ে গিয়েছিল।
এরপর স্যারের সঙ্গে প্রায়ই মিটিং করতে হতো ইউকসুর বার্ষিকী সম্পাদক হিসেবে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল টেকনিক্যাল জার্নাল বের করার। এটা এমন টেকনিক্যাল জার্নাল, যাতে লেখা ছাপা হলে শিক্ষকেরা প্রমোশন পেতে পারেন। আমি ফোর্থ ইয়ারের খারাপ ছাত্র এবং এটায় বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা লিখবেন, এটা সম্পাদনার কোনো যোগ্যতা আমার ছিল না। এই জন্য জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে চেয়ারম্যান করে এডিটরিয়াল বোর্ড করা হলো। সেই বোর্ডের মিটিংয়ে আমি উপস্থিত থাকতাম। আমি পাস করে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও মিটিং হতো। আমি তাতেও থাকতাম। আমার সময়ে ওই জার্নাল বেরিয়েছিল। তবে এর কপি কম ছাপা হয়েছিল, সব ছাত্রকে দেওয়া হয়নি। টেকনিক্যাল জার্নালের হয়তো এটাই নিয়ম।
স্যার তখন আমার খোঁজ নিতেন: তুমি কী করছ?
পূর্বাভাস পত্রিকায় কাজ করছি।
ভেরি গুড। করো। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা সব করতে পারে। দেখো, আবুল হায়াত কত সুন্দর অভিনয় করছেন।
এরপর স্যার পূর্বাভাস অফিসে ফোন করতেন। আনিসুল হক, কেমন আছ? তোমার লেখা পড়ি। তুমি এই লাইনে থেকে যাও।
স্যার প্রতিবছর বইমেলায় যেতেন। আর আমি দৌড়ে গিয়ে স্যারকে আমার নতুন বই দিয়ে আসতাম। স্যার পড়তেন আর আমাকে ফোন করতেন।
একবার বুয়েটে আর্কিটেকচারের ভর্তি পরীক্ষা বদলানোর চেষ্টা হলো। আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট ধর্মঘট করল। ব্যাপক গোলযোগ। আমি স্যারের কাছে গেলাম। স্যার, ব্যাপার কী?
স্যার বললেন, তুমি কি রশোমন দেখেছ?
আমি বললাম, আকিরা কুরোসোয়ার ছবি? জি দেখেছি।
এই সিনেমায় কী হয়? একটা ঘটনা ঘটে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সেটার বর্ণনা দেয়। কিন্তু প্রত্যেকের বিবরণ আলাদ। তাই না?
জি স্যার।
এখন আমি যদি এই ঘটনার বর্ণনা দিই, সেটা এক রকম হবে। আর্কিটেকচারের একজন টিচার যদি দেন, সেটা আরেক রকম হবে। তুমি সবারটা শোনো। তাহলে পুরা ছবিটা পাবে।
বুয়েটের কোন ছাত্র পৃথিবীর কোথায় কী কাজ করছে, সবার নাম ঠিকানা মুখস্থ বলতে পারতেন। এমনকি, বুয়েট থেকে বহিষ্কৃত হয়ে কে চীনে রাষ্ট্রদূত হয়েছেন, তা–ও স্যার গর্বভরে বলতেন। নিয়মিত সুডোকু সমাধান করতেন, যাতে মাথার কোষগুলো সজীব থাকে। গাড়িতে চলার সময় যানজটে বসে সামনের গাড়ির নম্বরটা দেখে সেই সংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করতেন।
স্যারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম আলোয়, তাঁর মৃত্যুর দশ দিন আগে। করোনাকালে সরকারের কী করণীয়, নাগরিকদের কী করণীয়। সেটা স্যারের লেখা হিসেবে পরের দিন প্রথম আলোয় ছাপা হলো। তিনি আমাকে এসএমএস পাঠালেন, আনিস, আমি কী এমন বললাম, তুমি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লিখেছ। ধন্যবাদ।
এটাই আমার সঙ্গে স্যারের সর্বশেষ কথা।
স্যার নেই, এ কথা মনে হলে এখনো বিষণ্ন হয়ে পড়ি। স্যার অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড। আমি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, স্যারকে প্রধান করে একটা টাস্কফোর্স করে দিন, যাঁরা সারা বাংলাদেশের কনটুয়ার ম্যাপ আর জনসংখ্যা ম্যাপ নিয়ে বসে একটা জাতীয় এরিয়া প্ল্যান করবেন, যাতে রেললাইন কোন দিক দিয়ে হবে, কোনটা নদীবন্দর, কোনটা শিক্ষা শহর হবে—তার একটা দিকনির্দেশনা থাকবে। সবাই ঢাকায় এলে এই শহর টিকবে নাকি! রাস্তাঘাট চলবে নাকি।
জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে এ রকম একটা পরিকল্পনার দায়িত্ব দিলে তিনিই পারতেন।
কারণ, তিনি ছিলেন মানবিক প্রকৌশলী। যিনি জানতেন শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, ফিল্ম এবং মানুষ নিয়েই একজন প্রকৌশলী। আর তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক মেধাবী একজন দেশপ্রমিক মানুষ। একজন সুন্দর মানুষ ছিলেন, সাধারণত হাফহাতা শার্ট পরতেন, সৌম্য-রঙের, টাগ-ইন করতেন না। আবার আনুষ্ঠানিক কোনা প্রোগ্রাম থাকলে স্যুট-টাইও পরতেন। কথা বলতেন মৃদুভাবে, কিন্তু বলিষ্ঠতার সঙ্গে। মুখে হাসি লেগে থাকত। সেই হাসিমুখটাই সব সময় মনে পড়ে। কোনো দিন বকা দিয়েছেন বলে মনে পড়েন না। শুধু ভালোবাসাই দিয়েছেন, আলো দিয়েছেন।
তাঁর শূন্যতা আসলেই পূর্ণ হবে না।
আনিসুল হক: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো