বাকী অংশ-
জেনারেল মইনকে আমি যা বলেছিলাম, তা এখন প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করছি। এ বিষয়ে আমি তাঁকে গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য বলেছিলাম। কারণ তখন পর্যন্ত আমি এবং আরও কয়েকজন—যাদের নাম আমি উল্লেখ করিনি—এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন এসব তথ্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিচারপতি খন্দকার হাসান মোহাম্মদ ফিরোজ ও সরকারি কৌঁসুলি যেন তা ধর্তব্যের মধ্যে আনতে পারেন। আর জনগণও তা জানতে পারেন।
এ বিষয়ে ভালোভাবে অবগত একজন সোর্সের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। স্থানীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর মঞ্জুরকে যখন সেনা হেফাজতে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়, তিনি তখন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে উপস্থিত ছিলেন। যেখানে মঞ্জুরকে বন্দী করে রাখা হয়, আমার সোর্স তাঁর খুব কাছাকাছি ছিলেন। সে কারণে তিনি বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মঞ্জুরকে চিনতেন। তাই ক্যান্টনমেন্টের সেই জায়গায় মঞ্জুরকে বন্দী করার জন্য আনা হলে তিনি তাঁকে চিনতে পারেন। আমার তথ্যদাতা সবকিছু নিজ চোখে দেখেছেন।
ফটিকছড়ির একটি গ্রামে মঞ্জুর শান্তিপূর্ণভাবে পুলিশের হাতে ধরা দেন। পরে তাঁকে হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। গল্পের এই অংশটা জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। সে সময়কার হাটহাজারী থানায় উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাঁর বিবরণের রসদ জুগিয়েছেন।
আমার সোর্সের বিবরণ শুরু হয় মঞ্জুরকে ক্যান্টনমেন্টে আনার পর থেকে। তাঁকে সেখানে নিয়ে আসার পরপরই এক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার হেফাজতে নেওয়া হয়। সেই কর্মকর্তা আসেন ঢাকা থেকে। সবাই বুঝে নেন, তিনি এসেছেন সেনাসদরের নির্দেশে, মঞ্জুরকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয় আমার সোর্সের কাছে অজানা নয়। তিনি তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের সেই বিশেষ জায়গায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন।
মঞ্জুরকে যে কক্ষে আটক করে রাখা হয়, সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আমার সোর্স সেখানে প্রবেশ করতে দেখেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে সোজা ঢাকায় চলে যান বলে শোনা যায়। আমার সোর্স সেই কক্ষে প্রবেশ করার সুযোগ পান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, মাথায় একটিমাত্র গুলির আঘাতে মঞ্জুর নিহত হয়েছেন। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
আমার মতে, এর মাধ্যমে আমি একটি নতুন বস্তুসম্মত তথ্য আদালত ও প্রসিকিউশনের কাছে পেশ করলাম। আমার সোর্স হন্তারক হিসেবে যাঁকে চিহ্নিত করেছেন, সেই ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার নামটি আমার জানা থাকলেও আমি এখন তা প্রকাশ করছি না।
আমার মত হচ্ছে, এই তথ্য আমার সোর্স প্রসিকিউশন ও আদালতের কাছে পেশ করুক, যদি তাঁকে বিপদে না ফেলে তাঁর সাক্ষ্য নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায়। সরকারের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ বটে। এই ব্যক্তি দেশের বাইরে থাকলেও তিনি বিপদমুক্ত নন। (চলবে)
লরেন্স লিফশুলৎজ
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা’জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?
OpenDoor.Lifschultz@gmail.com
হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর মঞ্জুরের ভাইয়ের এফআইআর
বরাবর তারিখ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম
পাঁচলাইশ থানা
চট্টগ্রাম
বিষয়: প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন।
প্রিয় মহোদয়,
আমি আবুল মনসুর—বাবা: মৃত মো. নজিবুল্লাহ, বাসা: ১/৫০১, ইস্টার্ন টাওয়ার, ২০ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা—প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে এই মর্মে এফআইআর দাখিল করছি যে, আমার ছোট ভাই সাবেক মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরকে ০১.০৬.১৯৮১ তারিখে চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ সুপারের আওতাধীন পুলিশ হেফাজত থেকে মেজর কাজী ইমদাদুল হকের নেতৃত্বে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়। সেনা হেফাজতে তাঁকে (আমার ভাই মেজর জেনারেল মঞ্জুর) চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর মাথায় সরাসরি নিশানা করে গুলি করা হয়। এতে তিনি নিহত হন। এটি সুনিশ্চিতভাবে একটি ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও মৃত্যুর সনদ সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ায় এর আগে আমি এফআইআর দাখিল করতে পারিনি। অতিসম্প্রতি এই প্রতিবেদন ও সনদ আমার হাতে এসেছে। এই এফআইআরটি দাখিলে বিলম্ব হওয়ার পেছনে এটাই কারণ।
আপনার কাছে অনুরোধ, অপরাধীদের যাতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, সে জন্য এ বিষয়ে বিলম্ব না করে যেন তদন্ত শুরু করা হয়।
আপনার বিশ্বস্ত
[স্বাক্ষর]
(আবুল মনসুর)
পাঁচলাইশ পিও কেস নম্বর ২৩
তারিখ ২৮-২-৯৫ আপ ৩০২ বিপিসি