তিতাসের সেবা নিয়ে প্রশ্ন

তিতাস গ্যাস কোম্পানি গ্রাহকের সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না, অথচ দাম বাড়ানোর অযৌক্তিক আবেদন করেছে।

তিতাস গ্যাস

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির শুনানিতে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস। গ্যাস সরবরাহ করা দেশের সবচেয়ে বড় এই কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম, অপচয় ও চুরির অভিযোগ এনেছে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ক্যাবসহ বিভিন্ন সংগঠন। তারা বলছে, মুনাফায় থাকা তিতাস গ্রাহকের সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না, অথচ দাম বাড়ানোর অযৌক্তিক আবেদন করেছে।

তিতাস গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গতকাল রাজধানীর ইস্কাটনের বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শুনানির আয়োজন করে। শুনানির আগেই ভোক্তা পর্যায়ে ১১৭ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল তিতাস। এটি যাচাই–বাছাই করে গড়ে ২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, তিতাসের কাছ থেকে রাজস্ব ও লভ্যাংশ হিসেবে শত শত কোটি টাকা নিচ্ছে সরকার। অথচ এর উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে না। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তারা, যা অযৌক্তিক।

সরকার মুনাফা নিচ্ছে কিন্তু দায় নিচ্ছে না বলে শুনানিতে মন্তব্য করে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, যথাযথভাবে আইন মানা হলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরিবর্তে আরও কমবে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, তিতাসের ৫৪ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে শিল্প খাত। অথচ চাহিদামতো গ্যাস পায় না শিল্পকারখানা। এর পরও সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দিয়ে যাচ্ছে এই খাত। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতকে ধ্বংস করার দিকে এগিয়ে না নিতে অনুরোধ করেন তিনি।

গ্যাসের চাপ কম থাকায় শত শত কোটি টাকার যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সিরামিক সামগ্রী রপ্তানিকারক সমিতির প্রতিনিধি গোলাম সারোয়ার। তিনি বলেন, আগে সেবা নিশ্চিত করতে হবে তিতাসকে। তারপর বাড়তি দাম চাইতে হবে। তা না হলে শিল্প ধসে যাবে।

মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করতে গিয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ আছে। সেগুলো কাটার পর আবার লাগানো হচ্ছে। লোকবল কম থাকায় তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারা যাচ্ছে না। বকেয়া বিল আদায় করতে হিমশিম খেতে হয়।

শুনানিতে আলোচনায় এসেছে, অবৈধ সংযোগের নামে শত শত কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। সিস্টেম লসের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। অথচ এসব বিষয়ে তিতাস কিছুই করতে পারছে না। তিতাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। একজন গ্রাহক জানতে চান, প্রিপ্রেইড মিটারের গ্রাহকেরা মাসে গড়ে কত টাকা বিল দেন। এর উত্তরে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। ওই ভোক্তা তখন বলেন, মিটার আছে মাত্র তিন লাখ গ্রাহকের। এর বাইরে থাকা লাখ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে মাসে প্রায় ৪০০ টাকা করে বাড়তি নিচ্ছে তিতাস।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নেওয়া দরকার। কিন্তু সেটি ঋণ করে নাকি সরকারের তহবিল থেকে টাকা আসবে, তা দেখার বিষয় আছে। সাধারণত মানুষ দুর্যোগে পড়লে শেষ সঞ্চয় ব্যবহার করে। গ্যাস খাতের সব সংস্থার কাছে ১২ হাজার কোটি টাকা জমা আছে।

বিকেলে কুমিল্লা অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ করা কোম্পানি বাখরাবাদের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর শুনানি হয়। আজ শুনানির শেষ দিনে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও সিলেট অঞ্চলের জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর শুনানি হবে। সব কোম্পানি একই হারে দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে।

শুনানিতে আরও উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য মকবুল ই ইলাহি চৌধুরী, মোহাম্মদ আবু ফারুক, মোহাম্মদ বজলুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান। শুনানি শেষে সবার প্রস্তাব ও মতামত যাচাই করে আগামী তিন মাসের মধ্যে চূড়ান্ত রায় দেবে বিইআরসি।

সুপারিশ কার্যকর হলে তিতাসের আবাসিক গ্রাহকদের দুই চুলায় গ্যাসের বিল বাড়বে ১০৫ টাকা। মাসে ৯৭৫ টাকা থেকে নতুন বিল হবে ১ হাজার ৮০ টাকা। আর এক চুলায় গ্যাসের বিল বাড়বে ৬৫ টাকা। ৯২৫ থেকে বেড়ে এক চুলার বিল হবে ৯৯০ টাকা।