একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক অবিস্মরণীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব অস্থির সেই দিনে বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের লড়াইকে দিয়েছিল একাগ্রতা। তাজউদ্দীন–কন্যা ও সাংসদ সিমিন হোসেন রিমি গ্রন্থনা করেছেন একাত্তরে দেওয়া তাঁর নির্বাচিক বক্তব্য।
১০ ও ১১ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁদের, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যত দিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যত দিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, তত দিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তাঁর রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের, সব দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামী মানুষের সঙ্গে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেক দিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।...
ভারতের পরে ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ।
আজ প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতাসংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের বীর বাঙালি যোদ্ধারা এই স্বাধীনতাসংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাঁদের কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।...
সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফকে, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে মেজর সফিউল্লাহর ওপর, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইপিআরের বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর…কুষ্টিয়া ও যশোর জেলার…মেজর জলিলের ওপর…ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল-পটুয়াখালীর।…উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নওয়াজেশ রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ অবরোধ করে বিব্রত করে তুলেছেন।…
আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সব সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করার বিরুদ্ধে নিষেধ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।…
বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে—একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহাঘ্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে—হানাদারদের রখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার।…
আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস। কারণ, প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।…যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হোক ‘জয় বাংলা’, ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।…
পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শতসহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তাঁরই নির্দেশে তাঁর লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তা কোনোমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। ওপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকেরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মতো। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এসব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো, তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তাঁর এ কাজ পাকিস্তানের বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালির রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নিমূর্ল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হলো আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসনব্যবস্থাকে নিমূর্ল করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলোকে ধূলিসাৎ করা, যাতে একটি জাতি হিসেবে কোনো দিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।…
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোনো শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না—আমরা আশা করি শুধু শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহাঘ্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারও তাঁবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
১৩ জুন ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একাদশ সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এই সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের বীর নরনারী অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতা লাভের দুর্জয় সংকল্প প্রকাশ করেছেন। নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত জয়লাভের ভরসা করেছিল শত্রুরা, কিন্তু বীর মুক্তিসংগ্রামীরা তাদের সে কল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।…
বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য আমরা পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আমাদের জনসাধারণ যে নির্যাতন ভোগ করছে, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু শুধু সে জন্য নয়, আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের জন্যই আমরা স্বীকৃতি দাবি করছি। আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে যে সমস্ত সরকার এখনো কোনো স্থির মনোভাব গ্রহণ করেনি, যাঁরা মাত্র মুখে এর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন, তাঁদের সবাইকে আমি জানাতে চাই যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে সেই স্থান তার স্থায়ী হবে। মানবজাতির বৃহৎ এই অংশকে স্বীকৃতি না দেওয়া কি যুক্তিসংগত? অথবা এসব রাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল?
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য পৃথিবীর সকল দেশের কাছে আবার আমি অস্ত্র সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি।…
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। এই ভারসাম্যের ওপর ভরসা করে শত্রুপক্ষ যা লাভ করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফল হতে পারেনি। এর নবতম প্রমাণ ভারত-সোভিয়েট মৈত্রী চুক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির যে বিস্ময়কর পরিচয় আমরা লাভ করেছি, নিঃসন্দেহে আমরা তারই ওপর নির্ভর করি।…
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হলো বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা। ঘৃণ্য টিক্কা খানের আসনে বেসামরিক ক্রীড়নক বসানো এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ধিক্কৃত বাঙালিকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিরূপে পাঠানো—এসবই তার ছদ্ম আবরণ। সে মিথ্যা আশা করে যে এতে অব্যাহত সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা ও জনমত দলনের নিষ্ঠুর সত্যকে ঢাকা দেওয়া যাবে।…
বাংলাদেশের গণহত্যায় যে বিশ্ববাসী শিউরে উঠেছে, তারাই এখন লক্ষ করছে যে জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের আয়োজন হয়েছে এবং তাঁর পক্ষ সমর্থনের জন্য খলনায়ক ইয়াহিয়া সন্দেহজনকভাবে আইনজ্ঞ চাপিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষ তাই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানি শাসক চক্রের মিথ্যা ভাষণে এবং তাদের কলঙ্কমোচনের কলাকৌশলে কেউ প্রতারিত হবে না।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা মেখে তাদের সুখের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন, দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দিজীবন যাপন করছেন। তাঁর বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করেছে বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের ওপর এর তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের ওপর যেসব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তিসাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই।…
পরিশেষে, যাদের সাহস আত্মোৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গৌরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কামনা করি সকল শক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসাধারণ নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে। এই ঐক্যই যেন আমাদের শক্তির চিরকালীন উৎস হয়।
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির জনসাধারণের পক্ষে এ এক বিজয়—বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, আর বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর।
স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ আজ সম্ভব হলো অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক তৎপরতা, অপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুর্ভেদ্য ঐক্যের ফলে। এ বিজয় ভারতের জনসাধারণেরও বিজয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের সর্বসম্মত অভিপ্রায় আজ বাস্তবে রূপায়িত হলো।
স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের জগৎসভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। এক কোটি ছিন্নমূল বাঙালির পরিচর্যার ক্লেশ স্বীকার এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধের আপদ বহন আর মানবতা ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি যে সুগভীর নিষ্ঠার পরিচয় ভারত দিয়েছে, তা বর্তমানকালের এক আশ্চর্য ঘটনারূপে বিবেচিত হবে। ভারতের এই দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের ভিত্তিমূলে এই ঐতিহাসিক অবদানের জন্য আমরা ভারতের জনসাধারণ, পার্লামেন্ট, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় বাঙালি জাতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। ভারতের এই স্বীকৃতিদান একটি মহৎ ঘটনা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও শ্রদ্ধাবোধ। বিপদের দিনে যুদ্ধের দুর্যোগের মধ্যে ভারতীয় জনসাধারণের সঙ্গে যে সম্পর্ক আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম, সম্পদে ও শান্তির কালে তা অক্ষুণ থাকবে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা উভয় জাতির স্থায়ী কল্যাণ সাধন করবে।
ভারতের পরে ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হলো, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাঁদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক। যে রূপকাহিনি ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে জোগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনির অংশ। তবু এই মুহূর্তে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।…
ইতিহাস আমাদেরকে যে দায়িত্বভার অর্পণ করেছে, এখন তা সম্পূর্ণ করতে হবে আমাদেরকেই। উন্মত্ত যুদ্ধবাদীদের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে কবর দিতে হবে আমাদেরকেই। চারপাশে মৃত্যুর জালে শত্রু জড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রশক্তির মিলিত আঘাতে শত্রু এখন পর্যুদস্ত-পলায়নপর। বাংলাদেশের ভাইবোনেরা, এখন সময় এসে গেছে—একযোগে শত্রুকে প্রবল আঘাত হানুন, এই শেষ আঘাতে তার সমাধি রচনা করুন, সকল সম্ভাব্য উপায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহাঘ্য করুন। শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের সঙ্গে সকল প্রকার সহযোগিতা করুন। ভবিষ্যৎ যেন এ কথা না বলে যে চরম আহ্বান যখন এল, তখন কর্তব্যে আমাদের ত্রুটি হয়েছে।…
যুদ্ধজয়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিকেও জয় করে আনতে হবে। নিষ্ঠুর যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ওপরে ‘সোনার বাংলার’ সৌধ নির্মাণ করতে হবে। পুনর্গঠন ও উন্নয়নের এই আনন্দদায়ক ও মহান কাজে অংশ নিতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি সন্তানকেই। বঙ্গবন্ধুর আরব্ধ বিপ্লব সেই দিন শেষ হবে, যেদিন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে।
জয় বাংলা।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম আজ সাফল্যের তোরণে উপনীত হয়েছে।…
২৫ মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে দুঃস্বপ্নের রাত্রি শুরু হয়েছিল, এত দিনে তার অবসান হলো। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কতৃর্ত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। এত অল্প সময়ে বোধ হয় আর কোনো জাতির স্বাধীনতাসংগ্রাম সফল হয়নি, স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বোধ হয় আর কোনো জাতি দেয়নি। আজকের বিজয় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়, সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের বিজয়।
আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আসুন, শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে, যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন সকলের মঙ্গলের জন্য।…
আমাদের সাফল্যের এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তিনি যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সংগত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে তার নজির নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের জনসাধারণকে যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে, সে বিষয়েও আমরা সচেতন। তাদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন।
আমাদের সংগ্রামের গতি দৃঢ়তাপূর্ণ সমর্থনদানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। পোল্যান্ড এবং অন্য যেসব দেশ আমাদের ন্যায় সংগ্রামকে সমর্থন করেছে, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা এ কথাও ভুলিনি যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরূপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহাঘ্য করেছেন।
দেশবাসী ভাইবোনেরা,
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনো শত্রুর কারাগারে। পাকিস্তানি শাসকদেরকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তাঁরা শেষ মুহূর্তেও অন্তত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন। এই দাবি মেনে নেবার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তানকে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।