তাঁর বেঁচে ফেরা যেন গল্প

কঠিন ট্রায়াথলন আয়রনম্যান চ্যাম্পিয়নশিপে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন ‘আয়রনম্যান’ মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত। মাত্র ২০ দিনে দৌড়ে পাড়ি দিয়েছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। এই তরুণের উদ্যমের গল্প থেকে জানা গেল দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা, যাঁরা তাঁর অনুপ্রেরণা। একজন বাবা মোশারেফ হোসেন, অন্যজন বাবার সহযোদ্ধা আবদুল মান্নান। এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা বললেন, তরুণেরা দেশকে আরও এগিয়ে নিক।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লাশের স্তূপের থেকে বেঁচে ফেরার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বীর প্রতীক। শনিবার পঞ্চগড় শহরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ এলাকায়

বাংকারে যুদ্ধের সময় গুলি শেষ হয়ে যাওয়া, হানাদারদের হাতে এক মাস ধরে নির্যাতন, তারপর চোখ বেঁধে গুলি—বীর প্রতীক আবদুল মান্নানের বেঁচে ফেরা গল্পের মতো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল মান্নান ছিলেন ২৫ বছরের তরুণ। এখন বয়স ৭৫ বছর। কিন্তু সেই সব দিনের কথা বলতে গেলে এখনো তাঁর রক্ত টগবগ করে ওঠে। আবার কখনো সহযোদ্ধাকে হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে পড়েন। কখনো কখনো মনে পড়ে ‘পাই’ নামের প্রিয় রেডিওটির কথা, যেটিতে তিনি যুদ্ধ শুরুর আগে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের খবর শুনতেন।

কীভাবে যুদ্ধে গেলেন, কীভাবে ধরা পড়লেন, কীভাবে বেঁচে ফিরলেন—সেই কথা শোনাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ১১ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলা শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভে এসেছিলেন। দুই ঘণ্টা ধরে আলাপে তুলে ধরেন সেই সব দিনের কথা। একপর্যায়ে তিনি কেঁদেও ফেলেন এই বলে যে পাকিস্তানিরা গুলি করার পর তাঁর মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯৭১–এ বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুক্তিযোদ্ধারা। এই ছবিটি হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের অন্যতম চিত্র

আবদুল মান্নান জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআরে (বর্তমানে বিজিবি) সিপাহি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইপিআরের দিনাজপুর সেক্টরের আওতায় ঠাকুরগাঁও উইংয়ের পঞ্চগড় কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ছিল তাঁর কর্মস্থল। পঞ্চগড় শহরসংলগ্ন করতোয়া সেতুর কাছে ছিল ইপিআরের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার। ২৫ মার্চের দিন কয়েক আগে পাঠান হাবিলদার মোগলবাজকে পঞ্চগড়ের চোপড়ামারী ক্যাম্পে বদলি করা হয়। চোপড়ামারী ক্যাম্পে পাঠান, পাঞ্জাবি ও বিহারি ছিলেন চারজন; আর বাঙালি ছিলেন চারজন।

লাশের স্তূপ থেকে বেঁচে ফিরেছি। এর মতো ভাগ্য আর হতে পারে না। তারপরও সারা দিন না খেয়ে যুদ্ধ করে গুলি আনতে যাওয়ার সময় চোখের সামনে সাত্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার দৃশ্য আজও আমাকে নাড়া দেয়।
বীর প্রতীক আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান বলেন, তিনি সব সময় রেডিওতে খবর শুনতেন। ২৫ মার্চ বিকেলে ক্যাম্পে বসে খবর শুনছিলেন। এ সময় হাবিলদার মোগলবাজ চড়াও হন তাঁর ওপর। খবর শুনতে বাধা দেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় প্রিয় রেডিওটি।

আবদুল মান্নানের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নিজের কর্মস্থল ইপিআর ক্যাম্পের পাঠান, পাঞ্জাবি ও বিহারি সৈনিকদের গুলি করার মধ্য দিয়ে। এরপর পঞ্চগড় থেকে ট্রাকে করে তিনিসহ তিনজন চলে যান ঠাকুরগাঁওয়ে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি, ইপিআর সৈনিক রহমান ও গাড়িচালক সাত্তার দিনাজপুরের কান্তা ফার্মের (বর্তমানে কান্তজিউ মন্দির) সামনে বাংকার খুঁড়ে যুদ্ধ করছিলেন। সন্ধ্যার দিকে তাঁদের গুলি শেষ হয়ে যায়। এ সুযোগে এগিয়ে আসে হানাদাররা। একপর্যায়ে গুলি সংগ্রহের জন্য বাংকার থেকে বের হলে সহযোদ্ধা সাত্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তখন আবদুল মান্নান ছিলেন মাত্র ১০ হাত দূরে।

আনোয়ার হোসেনের তোলা এই ছবিটি হয়ে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১–এ এটি তোলা হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি গ্রাম থেকে

সাত্তার নিহতের পর মান্নান ও রহমানকে আটক করে হানাদাররা। পাকিস্তানি সেনারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাঁদের হত্যা না করে প্রথমে সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সেখানে বন্দী রেখে প্রতিদিন তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। প্রায় এক মাস নির্যাতনের পর তাঁদের পাঠানো হয় রংপুর সেনানিবাসে। সেখান থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় মান্নান, রহমানসহ বেশ কিছু বন্দীকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর উপশহরের এক পুকুরপাড়ে। সেখানে লাইনে দাঁড় করে গুলি চালানো হয়।

আবদুল মান্নান বলেন, তাঁর ঘাড়ে ও হাতে গুলি লাগে। ঘাড়ের গুলিটি গলা ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। গলা ও বাঁ হাতের কনুইতে গুলির আঘাতের চিহ্ন এখনো রয়েছে। গুলি লাগার পর তিনি উপুড় হয়ে পড়ে যান। লাশের স্তূপের ওপর দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিলেন। পিপাসায় কাতরাচ্ছিলেন তিনি। একসময় বৃষ্টি নামে। কয়েক ফোঁটা পানি তাঁর মুখে পড়ে। পরে তিনি জ্ঞান হারান। যখন জ্ঞান ফিরে পান, তখন মধ্যরাত। এরপর লাশের স্তূপ থেকে বেরিয়ে পাশের একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে স্থানীয়ভাবে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। কিছুদিন পর তাঁকে ভারতের তরঙ্গপুর ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।

পরে সহযোদ্ধারা আবদুল মান্নানকে প্রথমে তেঁতুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ভারতের লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে থাকা অবস্থায় দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পান তিনি। দেশে ফিরে তিনি আবার বিডিআরে যোগ দেন।

আবদুল মান্নানের জন্ম নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। তবে তিনি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মোমিনপাড়া এলাকায় থাকেন। ইপিআরে চাকরির সুবাদে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তেঁতুলিয়ায় বসবাস শুরু করেছিলেন। যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে স্বাধীন দেশে বিয়ে করে সংসার পাতেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তাঁর।

বীর প্রতীক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাশের স্তূপ থেকে বেঁচে ফিরেছি। এর মতো ভাগ্য আর হতে পারে না। তারপরও সারা দিন না খেয়ে যুদ্ধ করে গুলি আনতে যাওয়ার সময় চোখের সামনে সাত্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার দৃশ্য আজও আমাকে নাড়া দেয়।’

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে বীর প্রতীক আবদুল মান্নানের স্বপ্ন, বাংলাদেশ একদিন দুর্নীতিমুক্ত হবে। তাঁর চাওয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন কেউ বিকৃত না করে। তিনি বলেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানুক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করুক, এটাই আমার কামনা।’