প্রতিবছর পঞ্জিকার নিয়ম মেনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আসে, কিন্তু সময়ের নিয়ম মেনে জ্যোতির্ময় ওই সব মানুষের জন্য বেদনার ভারটা যে কমার কথা, তা হয় না। এখনো মানুষ সমান শোক অনুভব করে, ৫০ বছর আগে ঘটে যাওয়া নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের বর্বরতাকে সমান ধিক্কার জানায় এবং কেন এই বর্বরতা, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। কিছু উত্তর আমরা পেয়েছি বটে; সেগুলো একাত্তরের ইতিহাস শুধু নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক শাসনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকেও পাওয়া। কিন্তু এসব উত্তর যদি পর্যাপ্ত হতো, তাহলে প্রতিবছর এই দিনের প্রাসঙ্গিকতা আমাদের সময়ের প্রেক্ষাপটে বিবেচনার একটা তাগিদ অনুভব করতাম না।
তা যে হয়নি, বরং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের পেছনের ইতিহাসের আরও কিছু উত্তর খোঁজার চেষ্টা যে প্রতিবছর আমরা করি এবং এই আত্মদান থেকে কী শিক্ষা আমরা নিতে পারি, তা নিয়ে ভাবি; তাতে এ সত্য প্রতিষ্ঠা পায় যে এই দিনকে এ সময়ের বাস্তবতা, নানা সংকট-সমস্যার প্রেক্ষাপটে ফেলেই বিচার করা প্রয়োজন। অর্থাৎ আমাদের শক্তি ও দুর্বলতা, অর্জন-অপূর্ণতার একটা হিসাব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের আলোকে বুঝে নিতে আমরা চেষ্টা করি। এই চেষ্টা আমাদের জন্য জরুরি।
গত দু–তিন দশকে আমাদের নানা পেশার ক্ষেত্রে কর্মদর্শনগত যেসব পরিবর্তন এসেছে, যেসব আচরণ ও চর্চা এখন প্রধান হচ্ছে, সেসব বিবেচনায় নিলে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসটির একটি গুরুত্ব বড় হয়ে ওঠে, দু–একটা প্রশ্নের উত্তরও আমরা পেয়ে যাই। একাত্তরের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনাশাসকদের একটা চোখ নিবদ্ধ ছিল রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ওপর, অন্যটি ছিল চিন্তানায়ক, শিক্ষাব্রতী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ব্যক্তিদের ওপর, যাঁরা তরুণদের মধ্যে মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ছিলেন। সেনাশাসকদের দৃষ্টিসীমায় ছিলেন সেসব চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও অন্যান্য পেশাজীবী, যাঁদের প্রভাব নিজেদের পেশা-অঞ্চলের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। রাজনৈতিক প্রতিরোধ কীভাবে ঠেকানো যায়, সেনাশাসকেরা তা জানত বলে ধরে নিত, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত প্রতিরোধ কীভাবে প্রতিহত করা যায়, তা তাদের সমরকৌশলে ছিল না। এ নিয়ে তাদের দুর্বলতা ছিল। ফলে তারা ভরসা রেখেছিল বুদ্ধিজীবীদের বিনাশে।
তাদের অনেক হিসাবে ভুল থাকলেও ‘বুদ্ধিজীবী’ সংজ্ঞাটি নির্ধারণে কোনো ভুল ছিল না। তারা ধরে নিয়েছিল, তাদের নিশানায় থাকা বুদ্ধিজীবীরা নতুন পথ দেখান, যুগাত্মাকে ধারণ করেন, চিন্তা ও কল্পনায় সক্রিয়তার নতুন সব মাত্রা যোগ করেন, পরার্থপরতার চর্চা করেন। যাঁদের তারা ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করল, সারা একাত্তর ধরেই অন্য অনেককে করল, তারা তা-ই করেছে। তাঁরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী দাবি করেননি, কিন্তু সত্যিকার বুদ্ধিজীবীর কাজগুলো করেছেন। তাঁরা আমাদের সংস্কৃতির সংগ্রামে, সংস্কৃতির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তাঁরা সংগ্রাম-রাজনীতির বার্তাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন।
আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে বুদ্ধিজীবিতার একটা বড় সংকট সহজেই ধরা পড়ে। বলে দেওয়া যায়, পেশাজীবীদের একটা বড় অংশ আর মানুষের সঙ্গে নেই, আছে সরকার বা নানা দলের সঙ্গে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক সরকারি ও সরকারবিরোধী তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা নানা লোভনীয় পদ পাওয়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন। এখন সংস্কৃতির রাজনীতি—যা সংস্কৃতির সূত্রগুলো মানুষের জীবনে প্রয়োগ করে এবং তা থেকে শক্তি অর্জনের রাজনীতি—গুরুত্ব পায় না, পায় দলীয় রাজনীতির সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি দলের ভেতরের নেতা–কর্মী ছাড়া অন্যদের জন্য হয় আত্মঘাতী। ফলে এখন তাঁরা আর মানুষের সংগ্রামে অংশ নেন না, মানুষের কাছে পরিবর্তনের, নতুন নির্মাণের কোনো বাণীও পৌঁছে দিতে পারেন না।
৫০ বছর আগের জ্যোতিষ্মান মানুষগুলো থেকে তাই বুদ্ধিজীবিতার একটা পাঠ (একটাই পাঠ, আপাতত) নেওয়া এবং প্রতিবছর তা নবায়ন করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। পাঠটা এই—মানুষের স্বার্থে, মানুষের জীবন সুন্দর ও অমলিন করতে, সংস্কৃতি ও শিক্ষার সৌন্দর্য দিয়ে তাদের জীবন গড়ে দেওয়ার ব্রতটাই বুদ্ধিজীবী শব্দটিকে মহিমা দেয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীরা তা করতেন বলে চরম শত্রুরাও তাঁদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁদের অনুপ্রেরণায় দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়বে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং তাদের ঔপনিবেশিক চক্রান্তের যোগ্য জবাব জানিয়ে তাদের সব স্বস্তি কেড়ে নেবে, এ রকম ভেবে আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে তাঁদের হত্যা করল।
তাদের সাধ পূর্ণ হয়নি, কারণ আলো দেখানো এসব মানুষকে এই জাতি কখনো ভোলেনি।