প্রিয়জনের মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের নিজের বিদায়ের অনুভবও মিশে যায়। করোনা অতিমারি শুরুর পর থেকে আমরা নিত্যদিন অভ্যস্ত হচ্ছি মৃত্যুর খবরে। তবে এই মরদেহ আমাদের কাছে শুধু খবরেই থাকে। কিন্তু যাঁরা প্রতিদিন মৃত ব্যক্তিকে খুব কাছ থেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে স্পর্শ করেন, তাঁদের অনুভূতি কেমন? কাজটি তাঁরা শুধু দায়িত্বের জন্য পালন করেন, নাকি এমন সময় নিজেদের মৃত্যুভাবনাও তাড়িত করে? এ বিষয়ে জানতে মরদেহ গোসল করানোর কাজে জড়িত—এমন চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। চারজনের প্রত্যেকেই এখন পর্যন্ত হাজারের বেশি মৃত ব্যক্তিকে গোসল করিয়েছেন। তাঁরা জানান, অনাত্মীয় মানুষটিও তখন আপন হয়। আবার কোনো কোনো স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হয় দীর্ঘদিন।
‘কখনো মরদেহের হাত বা পিঠের তাপ সুস্থ মানুষের মতোই উষ্ণ থাকে। গোসলের জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বিশ্বাস হয় না, মানুষটা আসলে নেই। বেশি খারাপ লাগে শিশুদের গোসল করাতে। চোখ–বন্ধ মুখটা দেখে মনে হয়, একটু পরই জেগে উঠবে ঘুম থেকে। সেই মৃত শরীর পাশ ফিরিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে নিজের চোখেও পানি আসে। আত্মীয় না হলেও ওই মুহূর্তে নিজেকে সবচেয়ে আপনজন বলেই মনে হয়।’ প্রায় এক দশক ধরে মরদেহ গোসল করানোর দায়িত্ব পালন করছেন সুমী আক্তার। এক হাজারের বেশি মরদেহ গোসল করিয়েছেন তিনি। প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে ৯ বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে গোসল করালাম। ওর মা–বাবা সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের কথা কী বলব, আমারই বারবার মনে হয়েছে, এতটুকু শিশু চলে গেল!’
প্রথম প্রথম সুমী তাঁর মা ফাতেমা বেগমের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। মা মারা গেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দায়িত্বটি তাঁকে দেয়। ব্যতিক্রম দু-একটা ঘটনাও ঘটে, যা দীর্ঘস্থায়ীভাবে থেকে যায় গোসলদানকারীদের স্মৃতিতে। তেমন কোনো ঘটনা আছে কি না, জানতে চাইলে সুমী আক্তার জানান, বছর দুই আগে দয়াগঞ্জের এক বৃদ্ধার মরদেহ এসেছিল। ঘরের ভেতর থেকে ১৪ দিন পর উদ্ধার করা হয় মরদেহ। দুই সপ্তাহে যে অবস্থা হয়েছিল, তা আর গোসল করানোর মতো পরিস্থিতিতে ছিল না। এ মরদেহর স্মৃতি দীর্ঘ সময় মনে প্রভাব রেখেছিল সুমীর।
কখনো কখনো সদ্যোজাত মৃত সন্তান আসে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মারা গেলে অবশ্যই তার গোসল হবে। মৃত অবস্থায় জন্মালে তাকে কাফনের কাপড় পরালেই হয়। মসৃণ চামড়ার নিচে রক্তপ্রবাহের শিরা স্পষ্ট থাকে শিশুদের। ওদের জন্য বেশি খারাপ লাগে।
সুমী আক্তার বলেন, ‘এসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশ মরদেহ দেখে মনে হয় শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। অনেক সময় দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা যাওয়া মানুষের মুখেও তৃপ্তির হাসির একটা রেশ থেকে যায়। গোসল করানোর দায়িত্বটি পবিত্র। তবে মৃত্যু তো সব সময় স্বাভাবিক হয় না, তাই গোসল করানোর সময় আমরাও সব একই রকম মরদেহ পাই না। বয়স, অসুখ, দুর্ঘটনার নানা ধরনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থারও রকমফের হয়। কিন্তু মরদেহের গোসল মানে আমাদের কাছে তার সবশেষ সর্বোচ্চ সম্মানের কাজটি করা। সেটা চেষ্টা করি।’
ঢাকার বাইরে হলেও ফরিদপুর সদরে অনেক বেওয়ারিশ মরদেহ আসে হাসপাতাল-পুলিশের হাত ঘুরে। আলীপুরের খাঁপাড়ার বাসিন্দা শেখ কুদ্দুস ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ মরদেহ গোসল করান, কখনো নিয়ে আসেন ভ্যানে টেনে আবার দাফনের কাজটিও করতে হয় তাঁকে। কখনো শীতের গভীর রাতে, কখনো ঝুম বৃষ্টির ভেতর তিনি মরদেহ ভ্যানে নিয়ে ছোটেন আলীপুর গোরস্থানের দিকে। শেখ কুদ্দুস বলছিলেন, ‘এই মফস্বল শহরে কমবেশি সবাই সবাইকে চেনে। সকালেই হয়তো বাজারে যাওয়ার পথে মানুষটা সামনে দিয়েই গেল। সালাম বিনিময় হলো। বিকেলে সে এল লাশ হয়ে। গোসল দিতে দিতে তার জন্য দোয়া করি। জীবন যে কত ক্ষণস্থায়ী—এ অনুভূতি হয়।’
হাজারের বেশি মরদেহকে গোসলদানকারী শেখ কুদ্দুস বলছিলেন, ‘মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে অবস্থানগত কোনো বৈষম্য থাকে না। যেকোনো মৃত ব্যক্তির গোসল একই মর্যাদা ও নিয়মের মধ্য দিয়ে আমরা সম্পন্ন করি। কিছুদিন আগে ফরিদপুর আড়াই শ বেড হাসপাতালে মারা যায় নাম না–জানা এক পাগল। তার মাথাভর্তি জটা। মাথাতেই আঘাত পেয়েছিল মানুষটা। হয়তো পথে কোনো গাড়ির সঙ্গে আঘাত লেগেছে বা কেউ মেরে জখম করেছে। সেখান থেকে শুরু হয় পচন। লাশ থেকে তখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
শেষবারের মতো পরিচ্ছন্ন, সুন্দর করানোর দায়িত্বটা আমার। জীবনভর কত কষ্ট করেছে কে জানে! পরিচয়হীন মানুষটির শেষবিদায়ের সব আয়োজনের দায়িত্ব ভালোবেসেই করলাম।’
প্রায় দেড় হাজার মরদেহ গোসল করানোর অভিজ্ঞতা হলেও দু-একটা ঘটনায় মন খারাপ হয়ে যায় বরগুনার তালতলীর মো. মনির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ১৩ বছরের এক কিশোরের মরদেহ এসেছিল। বাচ্চাটার ডেঙ্গু হয়েছিল। সন্তানের মরদেহ নিয়ে এসেছিলেন মগবাজারের বাসিন্দা বাবা-মা। এতটুকু বাচ্চার মরদেহ দেখলে মায়া হয় না? তবে অধিকাংশ মরদেহ দেখে মনে হয় প্রশান্তিতে আছে। কিছুদিন আগে মধ্যবয়সী একজনের মৃতদেহ নিয়ে আসা হলো। গোসল করানোর সময়ও বুঝতে পারিনি যে সে আসলে আত্মহত্যা করেছে। পরিবার জানায়নি। চিহ্নও ছিল না বোঝার মতো। একবার ট্রেনে কাটা পড়া ৫ থেকে ৬ টুকরা হয়ে যাওয়া একজনের মরদেহ গোসল করিয়েছিলাম। অথচ মানুষের মুখটায় মনে হচ্ছিল তখনো হাসি লেপটে আছে।
বহুবারই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মৃত মানুষের মুখে হাসি দেখেছি। কখনো কখনো মলমূত্র লেগে থাকে মৃত ব্যক্তির শরীরে। সেসব পরিচ্ছন্ন করতে হয়, তবে এ নিয়ে কোনো দিন খারাপ লাগেনি।’
মো. মনির হোসেন জানান, অনেক সময় মৃত ব্যক্তির পকেটে পাওয়া যায় টুকরা কাগজে লেখা কারও ফোন নম্বর, নাম বা নিজের পরিচয়পত্র অথবা কিছু টাকাপয়সা। সেসব সঙ্গে থাকা মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া আমানতের অংশ। এই টুকরা কাগজ দেখে মনে হয়, আহা মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও জীবনে ছিলেন! এই ফোন নম্বর টুকে রাখা বা নিজের পরিচয়পত্র পকেটে বয়ে বেড়ানো—এসবই জীবনের দাগ।
যে চারজনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ যাত্রাবাড়ীর হালিমা বেগম। দেড় হাজারের বেশি মৃত নারী ও কন্যাশিশুর গোসল সম্পন্ন করেছেন তিনি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস সময়ে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু দায়িত্বটা এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে মাঝরাতেও মরদেহ এলে উপস্থিত হতে হয় গোসল করাতে। ভোটার আইডি কার্ডের হিসাবে বয়স ৬০ হলেও আসলে নাকি আরও বেশি বলে নিজেই হাসতে হাসতে জানান হালিমা বেগম। এ বয়সে হঠাৎ ছুটে আসতে কষ্ট হয় কি না, তা জানতে চাইলে বলেন, ‘নিজের শরীরের কথা তখন মনে হয় না। আগে ভাবনায় আসে, না যাওয়া পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির শেষ কাজটা বাকি থাকবে। মৃত্যুর পর যত দ্রুত দাফন হয় তত ভালো, না হলে কষ্ট হয় মুর্দার। এই ভাবনার কাছে আসলে রাত না দিন, ঝড় না রোদ, আমার বয়স কত, তা মনে আসে না। প্রত্যেক নারী ও কন্যাশিশুর গোসল করানোর সময় আমি মনে মনে ভাবি, নিজে যেমন যত্ন নিয়ে গোসল করাব, ঠিক তেমনই যেন আমার ভাগ্যে থাকে। এই চিন্তায় বিশ্বাস করলে যেকোনো গোসলদানকারী তাঁর সবটুকু আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা করবেন মৃত ব্যক্তির গোসল সম্পন্ন করার।’
যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সরণিতে বসবাস করেন হালিমা বেগম। খবর পেলেই যেকোনো সময় ছুটে আসেন মুগদার আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে। মৃত ব্যক্তির গোসল করান বলে স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন আপনাকে নিয়ে? হাসিমুখে জানান, সবাই তাঁকে সম্মান করে।
সারা দেশে, এই নগরে দুর্ঘটনা, হত্যা, আকস্মিক অসুস্থতায় বা অনেক কারণে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয় মানুষ। মরদেহ রাখা হয় হাসপাতালের মর্গে। স্বজনদের সন্ধান না পাওয়ায় লাশগুলো অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ, এটাই বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিশ লাশের স্থান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাতব্য সংস্থায়। তারা সম্পন্ন করে লাশ দাফনের প্রক্রিয়া।
করোনা অতিমারি শুরুর পর থেকে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এসেছে মরদেহের গোসল দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণে। গোসল করানোর দায়িত্বে থাকা যাঁদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তাঁদের মধ্যে তিনজনই আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তালিকাভুক্ত। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টি ও সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ প্রথম আলোকে জানান, বেওয়ারিশ মরদেহগুলোর দাফন ও গোসল হয় জুরাইন কবরস্থানে। সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থা আছে, তবে বেওয়ারিশ মরদেহের কাফন থেকে শুরু করে দাফনের সবকিছু দিয়ে থাকে এ প্রতিষ্ঠান। মুগদা কার্যালয়ে গোসল করানো হয় ওয়ারিশ মরদেহের। এই গোসলদানকারীদের কর্মজীবনে কখনো শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হিসাবে গত ১১ বছরে ১২ হাজার ৯০৮টি বেওয়ারিশ মরদেহ দাফন করেছে তারা। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দাফন হয়েছে ১৪৩টি বেওয়ারিশ মরদেহ।
জীবনের আশ্চর্য নিয়ম হচ্ছে নিজের শেষ সময়ের কিছুই আর মানুষের নিজের হাতে থাকে না। এ বছরের ২৮ জুন চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মিনু আক্তার নামের এক নারী। অসহায় অভাবী মিনু আক্তারের বিনা অপরাধে কারাভোগের ঘটনা বাংলাদেশে আলোচিত। মৃত্যুর এক দিন পরও কোনো পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে তাঁর মরদেহ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। আবার ২০১৮ সালের নভেম্বরে বেওয়ারিশ হিসেবে গোসল করানোর সময় এক ব্যক্তির কোমরে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্র ও কাগজ থেকে জানা গিয়েছিল, তিনি চট্টগ্রামের বিত্তবান পরিবারের সদস্য। বেওয়ারিশ বা ওয়ারিশ—সব মরদেহই সমান হয়ে যায় গোসলদানকারীদের কাছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল বলেন, বেওয়ারিশভাবে উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করে থানা-পুলিশ। বেওয়ারিশ বা ওয়ারিশ যেকোনো মৃত ব্যক্তির গোসলদানকারীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এমনকি দুর্যোগের সময় জরুরিভাবে যাঁরা গোসল করিয়ে থাকেন, তাঁদেরও দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ।