রেহমান সোবহান, সরদার ফজলুল করিম, মীজানুর রহমান, এবিএম মূসা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাতের স্মৃতিকথা।
রেহমান সোবহান, সরদার ফজলুল করিম, মীজানুর রহমান, এবিএম মূসা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাত। দেশের বিশিষ্ট এই সাত ব্যক্তি আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। তাঁদের কর্মময় জীবন আর অবদান বাঙালি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। সাতজনের মধ্যে পাঁচজন প্রয়াত। বাকি দুজন, অর্থাৎ রেহমান সোবহান ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এখনো আলো বিলিয়ে চলেছেন। তাঁরা সবাই স্মৃতিভাষ্য লিখেছেন, সেসব বই আকারে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিতও হয়েছে। এসব বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে সেকালের ঢাকার সমাজচিত্র। তাঁদের বয়ানে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের ঢাকার নানা বিষয়।
আজকের আলো-ঝলমলে, বর্ণিল আর চাকচিক্যময় ঢাকার সঙ্গে সেকালের ঢাকার রয়েছে বিস্তর ফারাক। শহর ঢাকার বদলে যাওয়ার গল্পই লিখেছেন তাঁরা। ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিভাষ্য লিখতে গিয়ে তাঁরা মূলত বলেছেন ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি আর বিবর্তনের গল্প।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের পৈতৃক বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। তাঁর মায়ের পূর্বপুরুষ কাশ্মীরি হলেও অষ্টাদশ শতকে তাঁরা ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন। মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেহমান সোবহান ঢাকায় নানা খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসায় এক মাসের জন্য বেড়াতে এসেছিলেন। নাজিমউদ্দিন তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। থাকতেন বর্ধমান হাউসে, ১৯৫৪ সালে যার নাম বদল করে রাখা হয় ‘বাংলা একাডেমি’। পরবর্তীকালে ১৯৫৭ সালের ৩ জানুয়ারি রেহমান সোবহান পাকাপাকিভাবে ঢাকায় থাকার উদ্দেশ্যে চলে আসেন।
রেহমান সোবহান ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রথমবার এসে জনজীবনের যে দৃশ্য দেখেছেন, এর বিস্তর ফারাক দেখতে পান ১৯৫৭ সালে। তাঁর আত্মজীবনী উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো (সেজ পাবলিকেশন, ভারত, ২০১৮) বইয়ে তিনি এর কিছুটা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৫৭-য় যখন ফিরে এলাম, তত দিনে ঢাকা অনেকটা শহরের চেহারা নিয়েছে, মফস্বল টাউন আর নেই।...তখন নতুন আবাসন উন্নয়ন হিসেবে ইস্কাটন গার্ডেনস এবং নিউ ইস্কাটন গড়ে উঠেছে, সাত নম্বর রোড অবধি তৈরি হয়েছে ধানমন্ডি। ঢাকার সেই শুরুর দিনগুলোতে ধানমন্ডির চার নম্বর রাস্তায় আলিজুন ও খলিল ইস্পাহানির বাড়িতে নিয়মিত যেতাম। তখনো এলাকাটা প্রান্তিক মনে হত।...নিউ মার্কেট তৈরি হয়ে গিয়েছে, এবং তখন সেটা জিন্নাহ অ্যাভিনিউ, এখনকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, পাশাপাশি মূল শপিং সেন্টার।’
এ তো গেল ১৯৫৭ সালে রেহমান সোবহানের দেখা ঢাকার বর্ণনা। পাশাপাশি ১৯৪৮ সালের ঢাকার কথাও তাঁর আত্মস্মৃতিতে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৪৮-এর ঢাকার স্মৃতি খুব সামান্যই মনে পড়ে। আমার পরিচিতির সীমা ছিল ময়মনসিংহ রোড এবং ঢাকা নবাব পরিবারের পৈতৃক এস্টেটের মতিঝিলের দিলকুশা গার্ডেনস অবধি। এস্টেট ঘেঁষা ছিল খোলা পল্টন ময়দান যেখানে ফুটবল-ক্রিকেট খেলা হত। আমার মনে আছে এখানে একটা ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছিলাম নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের মধ্যে।...ময়দানের একদিকে ব্রিটানিয়া টকিজ নামে একটা টিনের চালের কাঠামোর অস্থায়ী সিনেমা হলে ভালো প্রিন্টের ইংরেজি সিনেমা দেখানো হত।...অল্প সময় সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম উত্তরে ময়মনসিংহ রোডে অবস্থিত পরীবাগ এবং বাইতুল আমানে। তখন ইস্কাটন নেই, তেজগাঁও নেই, ধানমন্ডিও নেই। এসব এলাকার বেশির ভাগ তখন খোলা মাঠ।’
সরদার ফজলুল করিমের (১ মে ১৯২৫—১৫ জুন ২০১৪) আত্মজীবনী ও অন্যান্য বইটি চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। এ বইয়ে চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশকের দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ বর্ণিত হয়েছে। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের ঢাকার সমাজ ও রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ এখানে পাওয়া যায়।
সরদার ফজলুল করিম বইয়ে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন ওয়ার্কশপের শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মী ও তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দের খুন হওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রজীবন, প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা, ১৯৪৫ বা ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় জার্নাল প্রকাশ হওয়া, রাজনীতির কারণে তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন ও কারাবাস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিকের জীবনকেন্দ্রিক রচনাও ঠাঁই পেয়েছে।
ঢাকা কীভাবে ধীরে ধীরে তাঁর চোখের সামনে বদলে গেছে, সেসবই মীজানুর রহমান (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১—২৫ জুন ২০০৬) লিখেছেন ঢাকা পুরাণ (প্রথমা, ২০১১) বইয়ে। বইয়ের লেখক মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা শীর্ষক একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বইয়ে বিশেষত পুরান ঢাকা ও এর বাসিন্দারা বৃহৎ পরিসরে এসেছে। দেশভাগের পর ঢাকার জনজীবনের চালচিত্র অসামান্য বর্ণনায় লেখক উপস্থাপন করেছেন। এখনকার সময়ে এসে ২১৬ পৃষ্ঠার এ বই পড়লে সেকাল ও একালের ঢাকার সাদৃশ্য খুঁজতে গেলে আগেকার সবকিছুই অবিশ্বাস্য মনে হবে। পুরো বইয়ে ঢাকার বিচিত্র সব বিষয়ের ঘটনা ধরা আছে।
মীজানুর রহমান বইটি শুরুই করেছেন ১৯৫০ সালের কথা দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘তখনো ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি ও রিকশারই দাপট। আর লোকসংখ্যা রাজধানীর গুণে বেড়ে লাখ পাঁচ-ছয় হবে।’ মাত্র ৭১ বছরের ব্যবধানে রাজধানীর বাসিন্দা দাঁড়িয়েছে দুই কোটির বেশি। একই সময়ের ব্যবধানে ঢাকার চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মীজানুর রহমান তাঁর বইয়ে সুনসান এক গ্রামীণ ঢাকার গল্প শুনিয়েছেন, এখন সেই ঢাকা যেমন ঘিঞ্জি, তেমনই বহুতল ভবনে ঠাসা।
এবিএম মূসার (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১—৯ এপ্রিল ২০১৪) আত্মজীবনী আমার বেলা যে যায় (২০১৪) প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। এখানে তিনি ১৯৫৪ সালে জাতীয় প্রেসক্লাব (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রেসক্লাব) গঠনের ইতিহাস উল্লেখ করেন। তাঁর লেখায় প্রেসক্লাবের সে সময়কার ক্যানটিনের খাবারের প্রসঙ্গও আছে। তিনি লিখেছেন, ‘এক আনায়, মানে ছয় পয়সায় চা, দুই পিসের বাটার টোস্ট একখানা। তখনই চালু হয়েছিল প্রেসক্লাবের ঐতিহ্যবাহী আন্ডাপুরি। ঢাকায় তখন এই খাবারটির নতুনত্ব এতই প্রচার লাভ করেছিল যে, বাইরের বন্ধুবান্ধবেরা আবদার ধরতেন, “দোস্ত, তোদের ক্লাবের আন্ডাপুরি খাওয়াবি?” দুপুরে ভাত-ডাল-মাছ, সঙ্গে ভাজি। দিতে হতো আট আনা। ৫০ পয়সায় পেটপুরে খাওয়া। রোববারে ফিস্ট, বিশেষ খাওয়া। সবাই আসতাম সপরিবারে, মানে যাদের পরিবার ছিল। বিশেষ খাওয়াদাওয়া মানে পোলাও, মুরগি, ডিম এবং পুডিং—মূল্য এক টাকা ২৫ পয়সা মাত্র।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দুই যাত্রায় এক যাত্রী (পার্ল পাবলিকেশনস সংস্করণ, ২০১০) আত্মজীবনীর বিভিন্ন অংশে ঢাকা নিয়ে বিস্তর স্মৃতিচারণা করেছেন। তিনি তৎকালীন পোশাক-পরিচ্ছদের কথা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমি এবং আমরা হাফপ্যান্টই পরতাম বলে মনে করতে পারি। পাজামা এবং শার্ট এল কলেজপাঠের সময়ে। ফুলপ্যান্ট ধরেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পরে।’
ঢাকাইয়া সংস্কৃতিতে লুঙ্গি পরার চল এখন একেবারেই নেই। সেটা পঞ্চাশের দশকেও খুব একটা ছিল না। সিরাজুল তাঁর আত্মজীবনীতে বলছেন, ‘পঞ্চাশের দশকে আবাসিক হলে তো বটেই, ডাইনিং হলেও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় কাউকে কাউকে দেখা যেত; একবার একজন তো কলাভবনেই চলে গিয়েছিল ওই পোশাকে, গিয়ে অবশ্য নিজের ভুলটা টের পেয়েছে এবং আর কখনো ওই কাজ করেনি।’
ঢাকায় তখন মোটরযানের সংখ্যা খুবই কম ছিল। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘কলাভবনে প্রক্টর ড. মযহারুল হকের অতি পুরাতন ফোর্ড মডেলের ছোট কালো গাড়িটি ছাড়া অন্য কোনো যন্ত্রচালিত যান দেখা যেত না। ছেলেমেয়েদের কারো কারো বাড়িতে হয়তো গাড়ি ছিল, কিন্তু গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউই আসত না। একটা সংকোচ ছিল। এই সংকোচ ভেঙে গেছে আইউব খানের সামরিক শাসনের শেষ পর্যায়ে। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের কিছুটা আগে নতুন কলাভবনে আমরা উঠে আসি। আটষট্টিতে যখন উচ্চশিক্ষার পালা শেষ করে দেশে ফিরলাম তখন দেখি কলাভবনের চত্বরটা মোটরগাড়ির গমনাগমনে বেশ শিহরিত। শিক্ষকদেরও কারো কারো গাড়ি আছে।’
আনিসুজ্জামানের (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০) তাঁর আত্মজীবনী কাল নিরবধিতে (সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৩) চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের ঢাকার অনবদ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁর স্মৃতিভাষ্য ঢাকার সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রূপান্তরের এক মূল্যবান ও ঐতিহাসিক দলিল।
বর্তমানে যে শান্তিনগর এলাকা ঢাকার ব্যস্ততম স্থানগুলোর একটি, সে এলাকাকেই চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি বলা হতো ‘ঢাকা শহরের বাইরের’ এলাকা। আনিসুজ্জামান শান্তিনগর প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘বিদ্যুৎ ও কলের পানি তখনো সেখানে পৌঁছায়নি—ছোটো রাস্তা, দুপাশে প্রচুর গাছপালা, এখানে-ওখানে পুকুর। পাখ-পাখালির আওয়াজ পাওয়া যেত, ফুলের সুঘ্রাণ অকস্মাৎ নাকে এসে লাগত।’ বর্তমানের শান্তিনগরের সঙ্গে এ চিত্র এখন একেবারেই বেমানান।
শুধু কি শান্তিনগর? একই কথা পুরানা পল্টনের ক্ষেত্রেও। আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সেই ১৯৪৯-৫০ সালে পুরানা পল্টন ছিল ঢাকার একটি প্রান্ত।’ ১৯৪৯ সালে রেসকোর্স ময়দানে ‘বিশাল এলাকা টিন দিয়ে ঘিরে বেশ কয়েক দিন ধরে’ ঢাকায় প্রথম যে শিল্প প্রদর্শনী হয়েছিল, এর বর্ণনাও তিনি আত্মজীবনীতে দিয়েছেন। ঢাকার সমাজ-সাহিত্য-অর্থনীতি-সংস্কৃতির নানা বিষয় আনিসুজ্জামানের লেখায় এসেছে। ১৯৫০ সালে তাঁর বাবার ৫ হাজার টাকা দিয়ে পুরোনো অস্টিন-৮ মডেলের গাড়ি কেনা কিংবা কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কীভাবে ঢাকায়ও শুরু হয়—এরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সবিস্তার এসেছে ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গও।
আনিসুজ্জামান কাল নিরবধিতে পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘সেকালে নতুন ও পুরোনো ঢাকার সীমারেখাটা টেনে দিয়েছিল নবাবপুরের প্রান্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলসড়কের ফটকটি। ফটকটির এদিকে ঢাকার ডাকবাংলো দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন ঢাকার নিশানা। ডাকবাংলোর একতলায় ভালো রেস্টুরেন্ট ছিল, তবে অভিজাত বলে পরিচিত ছিল আরেকটু সামনের ডিয়েনফা।...ডিয়েনফার মুখোমুখি ব্রিটানিয়া সিনেমা হল: জীর্ণদশা, তবু ভালো ভালো ইংরেজি ছায়াছবি প্রদর্শনের জায়গা। ডিয়েনফায় খাওয়ার এবং ব্রিটানিয়ায় ছবি দেখার আকর্ষণ ছিল দুর্বার।’
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে ঢাকা শহরে প্রচুর খাল ছিল। এরশাদের শাসনামলে এসব খাল ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হয়। প্রয়াত কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত তাঁর আত্মস্মৃতি হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজেতে (জার্নিম্যান বুক্স, ২০২০) লিখেছেন, ‘পুরান ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে খাল প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ত। মাটির হাঁড়ি, লাকড়ি ও নানা ধরনের জিনিসপত্র, এমনকি তরিতরকারি বিক্রেতারা এখানে নৌকা করে এনে বিক্রি করত। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের ঢাকার জনজীবনের সঙ্গে খাল গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। বহু বাড়িঘরের পয়ঃপ্রণালি ছিল এই খাল। বর্ষাকালে জলে স্রোত থাকায় কোনো দিনই জল দূষিত হয়নি।...সারা শহরেই খাল ছিল, এই খালই শহরের মধ্যে এঁকেবেঁকে এদিক-সেদিক হয়ে বুড়িগঙ্গা। ধোপারা কাপড় কাচত। জল স্বচ্ছ ছিল। এই খাল এঁকেবেঁকে মতিঝিলে গিয়ে পড়েছে। মতিঝিলের সঙ্গে সংযোগ ছিল এই খালের।’
১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকায় জন্ম নেওয়া আবুল হাসনাত তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থে তাঁর দেখা শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দেখা ঢাকার চালচিত্র অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। এ বইয়েই তিনি জানিয়েছেন, পঞ্চাশের দশকে ধানমিল এলাকায় ধানের চাষ হতো। মাটির ঘরও ছিল তখনকার সময়ে ঢাকা শহরে। এ ছাড়া তাঁর বইটিতে তৎকালীন শহরের জীবনযাপন ও চালচিত্রের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, প্রথা-সংস্কার, শিক্ষা, অর্থনীতি, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ঢাকাইয়া ভাষা, খাদ্যাভ্যাসসহ নানা বিষয় বর্ণিত আছে। তাঁর বইয়ের পরতে পরতে গ্রামীণ ঢাকার শহর হয়ে ওঠার প্রাঞ্জল ও মনোমুগ্ধকর বর্ণনা রয়েছে।