দেশের তরুণদের বেশির ভাগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সন্তুষ্ট। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও সন্তুষ্টি আছে। তবে ব্যক্তি এবং একই সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে তরুণদের উদ্বেগ বাড়ছে। এর মধ্যে শহরের তরুণ, নারী ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তুলনামূলক বেশি।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তরুণদের মধ্যে সন্তুষ্টি থাকলেও রাজনীতির প্রতি তাঁদের আগ্রহ দিন দিন কমছে। আগ্রহ বাড়ছে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো সামাজিক আন্দোলনের দিকে।
প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপ-২০১৯-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণের মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি তৈরি করা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করেন বর্তমানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন নিরাপত্তার অবস্থা খুবই খারাপ। আর ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছেন নিরাপত্তার অবস্থা মোটামুটি খারাপ।
এর আগে ২০১৭ সালের জরিপে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ বলেছিলেন নিরাপত্তার অবস্থা খারাপ। আবার তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তার অবস্থা খুব খারাপ বলেছিলেন ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ নিরাপত্তার অবস্থা খুব খারাপ মনে করা তরুণের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
আবার অনেকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বর্তমান অবস্থাকে ভালোও বলেছেন। এবারের জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ এমনটা মনে করেন। খুবই ভালো মনে করেন ৮ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ। অর্থাৎ তাঁরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। বাকি ৫ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়ে নিশ্চিত নন বলেছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণেরা নিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পাঁচটি শ্রেণিতে তাঁদের মতামত তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো খুব ভালো, মোটামুটি ভালো, নিশ্চিত নয়; মোটামুটি খারাপ ও খুব খারাপ। খুব খারাপ ও মোটামুটি খারাপ মিলিয়ে ধরা হয়েছে খারাপ অবস্থা। আর খুব ভালো ও মোটামুটি ভালো যোগ করে ধরা হয়েছে ভালোর হিসাব। জরিপে শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ, বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতাভিত্তিক শ্রেণিবিভাজন করা হয়।
দেখা যাচ্ছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় নিরাপত্তা নিয়ে বেশি শঙ্কিত। ৫৭ দশমিক ২১ শতাংশ নারী মনে করেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অবস্থা খারাপ। ছেলেদের বেলায় এ হার ৫১ শতাংশ। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলের তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেশি। শহুরে তরুণদের ৫৯ শতাংশ মনে করেন বর্তমান নিরাপত্তার অবস্থা খুবই খারাপ। বিপরীতে গ্রামের তরুণদের ৫২ শতাংশ এমন ধারণা পোষণ করেন।
নিরক্ষর মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন নন। নিরক্ষর মানুষদের প্রায় ৬৩ শতাংশ মনে করেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অবস্থা ভালো। এর বিপরীতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা আছে। যাঁরা যত বেশি শিক্ষিত, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তাঁদের তত বেশি। ন্যূনতম স্নাতক পাস করেছেন, এমন তরুণদের প্রায় ৬১ শতাংশ বলেছেন নিরাপত্তার অবস্থা খারাপ।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার অভাবটা সর্বত্র বিরাজমান। যখন-তখন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা আছে, মেয়েরা ভীষণভাবে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। আবার শিক্ষা শেষে কর্মজীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। তরুণেরা কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাষ্ট্র তা করতে পারছে না। এত লম্বা সময় ধরে নিরাপত্তাহীনতা এর আগে কখনো ছিল না। ক্রমে নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে চলেছে।
>তরুণেরা রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে সন্তুষ্টির কথা বললেও একই সঙ্গে রাজনীতিবিমুখতার কথাও জানিয়েছেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। তরুণেরা উপলব্ধি করছেন, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র বদলায়নি। তাঁরা হয়তো মনে করছেন, রাষ্ট্র এমনই থাকবে। কিন্তু যদি কিছু সামাজিক সমস্যা মেটানো যায়, সে কারণে সামাজিক আন্দোলনে ঝোঁক বাড়ছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া, পাড়া-মহল্লাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কমে আসা, কিশোর আন্দোলন গড়ে না ওঠা রাজনীতিবিমুখতার একটা বড় কারণ। এই রাজনীতিবিমুখতা জাতির জন্য খুবই ক্ষতিকর।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সন্তোষ
প্রথম আলোর জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৮০ শতাংশই বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ খুবই সন্তুষ্ট। আর ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্ট। এর বিপরীতে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ উন্নয়ন নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন। ৮ শতাংশ কিছুটা অসন্তুষ্ট এবং ৫ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ নিশ্চিত নন বলেছেন।
দেখা গেছে, শিক্ষিত-নিরক্ষর, গ্রাম বা শহর, নারী-পুরুষ, বয়সভেদে এই উন্নয়ন নিয়ে তেমন কোনো মতপার্থক্য নেই।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে তরুণদের মধ্যে সন্তুষ্টি আগের চেয়ে বেড়েছে। ২০১৭ সালের জরিপে ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে তাঁদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। তখন খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং কিছুটা সন্তুষ্ট ছিলেন ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ। বিপরীতে খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলেন ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও সন্তুষ্টি বেড়েছে
এখন রাজনীতির মাঠ অনেকটা শান্ত। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি নেই দীর্ঘদিন ধরে। সে অর্থে রাজপথে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নেই।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি তরুণ (৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ) সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা খুবই সন্তুষ্ট। ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ মোটামুটি সন্তুষ্ট। প্রায় ১৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে ঠিক নিশ্চিত নন।
দেখা গেছে, শহুরে তরুণদের চেয়ে গ্রামে বসবাসকারী তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্টি বেশি।
দুই বছর আগের তুলনায় এখন তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্টি বেড়েছে। ২০১৭ সালে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন ৪৮ শতাংশ তরুণ। বিপরীতে ওই বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন প্রায় ১৮ শতাংশ এবং কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলেন ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অবশ্য গত জরিপটা ছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালের টানা হরতাল-অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের দুই বছরের মাথায়। চার বছর ধরে সে রকম পরিস্থিতি আর সৃষ্টি হয়নি।
অবশ্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট তরুণের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। এবারের জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩১ দশমিক ২ শতাংশ) বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। এর মধ্যে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার জরিপে পাওয়া মতামত প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজেও ১০টি জায়গায় ৩০০ তরুণের ওপর একটি গবেষণা করেছেন। তিনিও অনেকটা একই চিত্র পেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তরুণদের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা রয়েছে। বিশেষ করে পুলিশের ওপর তাঁদের নানা ধরনের অভিযোগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণেরা উদ্বিগ্ন।
শান্তনু মজুমদার বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো তরুণদের রাজনীতিবিমুখতা। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব আছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে ধরতে তরুণদের মধ্যে সামগ্রিক রাজনীতি নিয়ে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। তিনি বলেন, তরুণদের নিয়ে খুব বেশি উদ্বেলিত হওয়ার কিছু তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। জাতীয় সমস্যা বা সমাজের চেয়ে তাঁরা নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি চিন্তিত।
সংশোধনী: ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন, এমন তরুণের হার ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আর তাঁদের মধ্যে ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশই ব্যবহার করেন ফেসবুক। জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ২০০ তরুণের সবার মতামত এটা নয়।