গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনেও দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারাসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত বলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মূলত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। অন্যদিকে নির্বাচনবিরোধীরা কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম পরিবহনে বাধা দেওয়া ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ বিভিন্নভাবে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া বানচালের চেষ্টা করে। কমপক্ষে আটটি আসনে কেন্দ্র দখল করে ইচ্ছামতো নিজের পক্ষে সিল মারার অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্বতন্ত্রসহ অন্তত ১৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: মাগুরা-২ (শালিখা-মহম্মদপুর ও সদরের একাংশ) আসনে জেলা সদরের তিনটি কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা এবং মহম্মদপুর উপজেলার একটি কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স লুট করা হয়। এ ছাড়া সদর উপজেলার শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী এসে ইচ্ছামতো সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে দেন। জামায়াত-শিবিরের প্রতিরোধের কারণে রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনের পীরগাছায় ৯০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫১টি ও কাউনিয়া উপজেলার দুটি কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে যেতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই কেন্দ্রগুলোতে ভোট হয়নি। পীরগাছার একটি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের সময় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদল ও যুবদলের সাত কর্মী আহত হন। শেরপুর-২ (নকলা ও নালিতাবাড়ী) আসনে ৫০টি কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি, জাল ভোট ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে নির্বাচন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বদিউজ্জামান বাদশা। শেরপুর-১ (সদর) আসনের দীঘারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ চলার সময় নির্বাচনবিরোধীরা হামলা চালিয়ে ব্যালট পেপারসহ ছয়টি বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে সরাইল উপজেলার উচালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ‘লাঙ্গল’ প্রতীকে সিল মারার সময় তিন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে হাতেনাতে আটক করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাঁরা হলেন কোহিনূর বেগম, জোবেদা বেগম ও নাসিমা বেগম। প্রথমজনকে পাঁচ বছর ও অন্য দুজনকে তিন বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের রৌমারী উপজেলার একটি ও কুড়িগ্রাম-১ আসনের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার একটি কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের পর ওই দুই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনের চাপাদহ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রওশন আলী জানান, সকালে ভোট গ্রহণ শুরুর পর শতাধিক লোক এসে হামলা চালিয়ে সাতটির মধ্যে ছয়টি ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে যান। এর পর থেকে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে। গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ মনোয়ার হোসেন নিজের দলের নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে ১৩টি কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনেছেন। গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্যাপুর-পলাশবাড়ী) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইউনুস আলীর বিরুদ্ধে একই রকম অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাসদের নেতা খাদেমুল ইসলাম। বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনে ভোটার হননি—এমন লোকও ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ৮ নম্বর উত্তর ভংগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা কেন্দ্রের ভেতরে অবস্থান নিয়ে অল্প বয়সীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। ওই কেন্দ্রের সামনে কথা হয় গত বছর মাধ্যমিক পাস করা মো. শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে। শাহাদাৎ জানায়, সে ভোট দিয়েছে। বয়স কত—জানতে চাইলে সে বলে, ১৬ বছর। কীভাবে ভোট দিয়েছে—জানতে চাইলে সে সরে পড়ে। পটুয়াখালী-১ (সদর, মির্জাগঞ্জ ও দুমকি) আসনের সদর উপজেলার ঘোপখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ ফাঁকা গুলি চালিয়ে তাদের প্রতিহত করে। লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকটি ব্যালট বাক্স লুট করে দুর্বৃত্তরা। চুয়াডাঙ্গা-১ (সদরের একাংশ ও আলমডাঙ্গা) আসনে জাসদ (ইনু) মনোনীত প্রার্থী এম সবেদ আলী অভিযোগ করেন, ভোট গ্রহণ চলাকালে নৌকা মার্কার কর্মী-সমর্থকেরা বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়েছেন। একই অভিযোগ করেছেন চুয়াডাঙ্গা-২ (সদরের একাংশ, দামুড়হুদা ও জীবননগর) আসনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম শেখ। তিনি দাবি করেন, তাঁর আসনের শতাধিক কেন্দ্র দখল করে নৌকার পক্ষে জাল ভোট দেওয়া হয়েছে। বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনে তালতলী উপজেলার চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালতলী বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গাবতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাওড়া-লোদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একে স্কুল, আমতলী মাদ্রাসা, পাতাকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ অন্তত ১২টি কেন্দ্র দখল করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথের লোকজন জাল ভোট দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরগুনা-২ (বামনা-বেতাগী-পাথরঘাটা) আসনে বেলা ১১টার দিকে পাথরঘাটা উপজেলার সবগুলো কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেন শিকদারের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকার সমর্থকেরা ইচ্ছামতো ব্যালট নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল দিতে থাকেন। দুপুর ১২টার পর বামনা ও বেতাগী উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র একইভাবে দখল করে নেন আওয়ামী লীগের সমর্থক, নেতা ও কর্মীরা। হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের বানিয়াচং উপজেলার ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১টি কেন্দ্র থেকেই জাতীয় পার্টির এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হবিগঞ্জ-৩ আসনে জাপার প্রার্থী আতিকুর রহমান দাবি করেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ৮৪টি ভোটকেন্দ্র দখল করেন ১৪ দলের প্রার্থী ও বর্তমান সাংসদ আবু জাহিরের লোকজন। হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনের প্রায় ৩০টি কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ তানভীর আহমেদের এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দিয়েছেন ১৪ দলের প্রার্থী মাহবুব আলীর লোকজন। নীলফামারী-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফতাব উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ডিমলা ইসলামিয়া কলেজ ভোটকেন্দ্র দখল ও ব্যালট ছিনতাই করে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাফর ইকবাল সিদ্দিকী।