ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের পর পেরিয়ে গেছে চার থেকে পাঁচ মাস।
দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ‘প্রতারণা’র ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়েছিল, তার তদন্তে বিশেষ কোনো অগ্রগতি নেই। তদন্ত যে খুব জোরেশোরে চলছে, তা-ও নয়। গ্রাহকেরাও কোনো অর্থ ফেরত পাননি। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে চার থেকে পাঁচ মাস।
পুলিশ, বাহিনীটির অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তথ্য বলছে, ই-কমার্সের নামে প্রতারণা ও অনলাইনে অবৈধ বহুস্তর বিপণন ব্যবসা (এমএলএম) চালিয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৪১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামি ১১০ জন। এর বাইরে অজ্ঞাতও রয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয় অন্তত ৩৬ জনকে।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত শেষ না হওয়ায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের কত টাকা আসলে হাতিয়ে নিয়েছে এবং কত টাকা তারা সরিয়ে নিয়েছে, তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ২৯টি মামলা তদন্তের দায়িত্বে থাকা সংস্থা সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত এখন মধ্যম পর্যায়ে রয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করা হচ্ছে।
দেশে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে একে একে ই-কমার্সের নামে মানুষকে পণ্য না দিয়ে প্রতারণার খবর আসতে থাকে। প্রথম বেরিয়ে আসে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি। গত ১৮ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা করেন একজন গ্রাহক। এতে জামিন নিতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমানকে কারাগারে পাঠান আদালত।
আর ই-অরেঞ্জের নেপথ্য মালিক বলে পরিচিত বনানী থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে গ্রেপ্তার হন। এরপর একে একে মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১০টি, ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৪টি, টোয়েন্টিফোর টিকিট লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৫টি, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধে ৪টি, ধামাকার বিরুদ্ধে ৩টি, র্যাপিড ক্যাশ কুইক, রিং আইডি ও সহজ লাইভ অ্যান্ড লাইভলি লাইফের বিরুদ্ধে ২টি করে এবং কিউ কম, সিরাজগঞ্জ শপিং, দালাল প্লাস, নিরাপদ শপ, থলে ডট কম অ্যান্ড উইকম ডটকম, আনন্দের বাজার ও আলিফ ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে ১টি করে মামলা রয়েছে।
আরিফ বাকের নামের এক গ্রাহকের করা মামলায় গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেল ও তাঁর স্ত্রী চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রেপ্তার হন। তাঁরা এখন কারাগারে।
সিআইডি জানিয়েছে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর অনলাইনে এমএলএম ব্যবসার আড়ালে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে রিং আইডির ১০ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঢাকার ভাটারা থানায় মামলা হয়। পরে রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। বাকি ৯ আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।
শুধু গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। সিআইডি জানিয়েছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, টোয়েন্টিফোর টিকিট লিমিটেড, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এবং সমবায় প্রতিষ্ঠান এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্তে ৫০০ কোটি টাকা অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) আইনে আলাদা পাঁচটি মামলা হয়েছে।
মানি লন্ডারিং আইনে হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপরাধলব্ধ আয়ের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
এদিকে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও সাইবার পুলিশ কেন্দ্র (সিপিসি) ৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অসংগতির বিষয়ে অনুসন্ধান করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিরাজগঞ্জ শপিং, আলেশা মার্ট, আলাদিনের প্রদীপ, কিউ কম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট ও নিডকমবিডি।
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ও সিপিসির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ও এস এম আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে জানান, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এদিকে মামলার বাদী ও সাধারণ গ্রাহকেরা তদন্তে বিশেষ অগ্রগতি না থাকায় হতাশ। তাঁরা বলছেন, সব টাকা ফেরত পাবেন কি না তা নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা রয়েছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকাও গ্রাহককে ফেরত দেওয়া শুরু করতে পারেনি সরকার।
একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা এক মামলার বাদী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বিষয়ে এখন আর পুলিশের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তিনি নিজের জমানো ও স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ৪৮ লাখ টাকার পণ্য কিনেছিলেন। টাকা ফেরত না পেয়ে তাঁর জীবন একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।