কোরিয়ান একটি অনলাইন শপিং প্রতিষ্ঠান ঢাকায় পণ্য সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানটির পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেন তরুণ মুরসালীন। ঢাকার ক্রেতাদের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিতে নিজের ফ্যাশনেবল সাইকেলটি তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিন বছর আগে ১১ হাজার টাকায় সাইকেলটি কেনেন তিনি। এই দ্বিচক্রযান মুরসালীনের রুটিরুজি ও নিরাপদ ভ্রমণের প্রধান বাহন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন গাজীউর রহমান। ঢাকার যানজট আর পরিবহনের ঝুঁকি-ঝক্কি এড়াতে নিয়মিত তিনি সাইকেল চালিয়ে অফিস করেন।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে প্রায় প্রতিনিয়ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে বাহারি ডিজাইনের সাইকেল চালিয়ে গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায়। নিরাপদ ভ্রমণে স্টাইলিস্ট ও ফ্যাশনেবল সাইকেলে ঢাকায় বেশি চলে। সাইকেল বিক্রেতারা বলছেন, তিন-চার বছর ধরে রাজধানীতে সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে। স্টাইলিস্ট বা ফ্যাশনেবল সাইকেলগুলোই সাইক্লিস্টদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। এসব সাইকেলের প্রধান ক্রেতা তরুণ প্রজন্ম।
সাইকেলভিত্তিক কমিউনিটি ও ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের অ্যাডমিন দ্রাবিড় আলম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ও সড়কপথ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০১৩-১৪ সালে তুলনায় এখন অফিসগামী সাইক্লিস্টের সংখ্যা কমেছে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিরাপদে সাইকেল চালাতে পছন্দ করেন—এমন সাইক্লিস্টের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
রাজধানীতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল বিক্রি হয়। সাইকেলের বাজারে চীনা কোম্পানিগুলোর প্রভাব থাকলেও দেশীয় কোম্পানির ভেলোস, রিফ্লেক্স, দুরন্ত ব্র্যান্ডের সাইকেলের কদর বেশ নজর কাড়ার মতো। তবে ইলেকট্রিক বা ব্যাটারিচালিত সাইকেলও মাঝে মাঝে এই মহানগরে চলতে দেখা যায়। সাইকেলের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো হচ্ছে জায়ান্ট, জিটি, সান্তা ক্রুজ, ট্রেক, স্পেশালাইজড, কোনা, মেরিডা, ক্যাননভেল, স্কট, মারিন ইত্যাদি।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার বংশাল সরেজমিনে কথা হয় ‘জে এস ইমপেক্স বাইসাইকেল’ নামে সাইকেল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ এম রেহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক বিবেচনায় আগের চেয়ে সাইকেলের বিক্রি বেশি। চায়নিজ ব্র্যান্ডের সাইকেল বেশি বিক্রি হয়। দেশীয় ব্র্যান্ডের মধ্যে ভেলোস সাইকেল বিক্রিতে এগিয়ে। ঢাকায় সচরাচর ফ্যাশনেবল সাইকেলগুলোই বেশি চলে।
সাইকেলের উচ্চতা
সাইকেলের চাকার ব্যাসার্ধের পরিমাণই হচ্ছে সাইকেলের আসল উচ্চতা। দেশের বাজারে সর্বনিম্ন ১২ থেকে সর্বোচ্চ ২৮ ইঞ্চি উচ্চতার সাইকেল পাওয়া যাচ্ছে। বয়স ও সাইকেল আরোহীর দেহের গড়ন অনুযায়ী ১২, ১৬, ২০, ২৪, ২৬ ও ২৮ ইঞ্চি উচ্চতার সাইকেল কেনার সুযোগ আছে।
বাজার
বংশালে সাইকেলের বাজার আছে। বংশালের কাজী আলাউদ্দীন রোডের আশপাশের এলাকায় রাস্তার দুপাশে চলে নানা ডিজাইন ও ফ্যাশনেবল সাইকেল বিকিকিনি। এখানে সাধারণ সাইকেল ও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের ফ্যাশনেবল সাইকেল পাওয়া যায়। শুক্রবার ছুটির দিন বাদে এই এলাকায় প্রতিদিন হিরো রেঞ্জার, হিরো, মেরিডা, ফরমেট, ভেলোস, দুরন্ত, ফিনিক্স, বেবি স্পেসসহ দেশি–বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া ঢাকার রামপুরা, গুলশান লিংক রোড, গুলশান-১–এর ডিএনসিসি মার্কেট, নিউমার্কেট, মৌচাকসহ বিভিন্ন স্থানে সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের শোরুমে সাইকেল পাওয়া যাচ্ছে।
হেলমেট
সচেতন সাইক্লিস্টরা দুর্ঘটনায় সুরক্ষার জন্য হেলমেট ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেলের হেলমেট পাওয়া যায়। দাম ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা মূল্যের বেশি সুবিধাসম্পন্ন হেলমেটও পাওয়া যায়।
দরদাম
সাইকেলের আকার-আকৃতি ও মানভেদে দাম ভিন্ন। সাধারণত শিশুদের সাইকেলের দাম ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। কিশোর-তরুণদের সাইকেলের দাম ৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে ইলেকট্রিক বা ব্যাটারিচালিত সাইকেলের দাম ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা শুরু করে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছাড়ের অফার থাকলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামেও কেনা সম্ভব।
বংশালের গ্রিন টাইগার সাইকেলের শো রুমে চীন থেকে আমদানি করা ব্যাটারিচালিত সাইকেল বিক্রি হয়। এখানে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা মূল্যের সাইকেল আছে। শো রুমটি ব্যবস্থাপক একরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা দামের সাইকেল। কিছুদিন আগে তাঁদের শোরুম থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের সাইকেল বিক্রি হয়েছে। অর্ডারের ভিত্তিতে তাঁরা ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের গ্রিন টাইগার সাইকেল সরবরাহ করেন। তিনি বলেন, এসব সাইকেলের ব্যাটারি চার্জ হতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে। প্রতি চার্জে ৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করা যায়। ঘণ্টায় গতি ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার। প্রতিবার চার্জে বিদ্যুৎ খরচ হয় ১০ টাকার মতো।
ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যালোচনাবিষয়ক ওয়েবসাইট ফিন্যান্সেস অনলাইন জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি সাইকেল হচ্ছে ‘বাটারফ্লাই ট্রেক মেডোন’। মার্কিন সাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ট্রেক’ সাইকেলটি তৈরি করেছে। এটি দিয়ে ফ্রান্স সফর করেছেন নামকরা সাইক্লিস্ট লেন্স আর্মস্ট্রং। পরে সাইকেলটি নিলামে বিক্রি হয়েছে ৫ লাখ ডলার (৪ কোটি টাকা)।
রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার দুরন্ত সাইকেল শো রুমের ব্যবস্থাপক কামাল পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের শো রুমে চারটি ক্যাটাগরির ফ্যাশনেবল দুরন্ত সাইকেল বিক্রি হয়। শিশুদের সাইকেলের দাম সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৮৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৩২০ টাকা। কিশোর ও তরুণদের সাইকেলের মূল্য ৭ হাজার ৪৪০ টাকা থেকে ৪৩ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকায় ফ্যাশনেবল বা স্টাইলিশ সাইকেলগুলোই বেশি বিক্রি হয়। ফলে তাদের শো রুমে থাকা সব সাইকেলই ফ্যাশনেবল। ঢাকার বাইরে যেসব সাধারণত সাইকেল চলতে দেখা যায়, সে রকম সাইকেল তাঁদের শোরুমে নেই বলেও জানান তিনি।
ঢাকায় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিংবা কর্মক্ষেত্রে যেতে অনেকে সাইকেল ব্যবহার করেন। অনেকে শখের বশেও সাইকেল চালান। কেউ কেউ ব্যায়াম, শারীরিক কসরত ও ভ্রমণের অংশ হিসেবে সাইকেলে আরোহণ করেন দলগতভাবে। ঢাকার নটর ডেম কলেজের একাদশ শ্রেণির বাণিজ্য শাখার ছাত্র আতিক ইয়াসির প্রথম আলোকে বলে, প্রাইভেটকারে কলেজে যাতায়াত করে সে। আর মাঝেমধ্যে একাই কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সাইক্লিং করে। কখনো কখনো দলবদ্ধ হয়ে সাইকেল ভ্রমণে বের হয়। স্টাইলিশ ও ফ্যাশনেবল সাইকেল ছাড়া সাইক্লিং জমে না বলেও জানায় এই শিক্ষার্থী।