শিশুটির বাবা চিকিৎসক। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শিশুটিকে প্রথমে নেওয়া হয় ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে। উন্নত চিকিৎসার আশায় তাকে পরে বড় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় ৪ জুলাই। ৫ জুলাই শিশুটি মারা যায়। মৃত্যুসনদে কারণ হিসেবে ডেঙ্গু জ্বরের উল্লেখ আছে।
অসহায় ও ক্ষুব্ধ বাবা শিশুটির চিকিৎসা ও মৃত্যুর সব তথ্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) দিয়েছিলেন। গত বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে যত মৃতের তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে শিশুটির উল্লেখ নেই।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে পাঁচজন। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ বছর মৃতের সংখ্যা সরকারি তালিকার চেয়ে বেশি। সরকারি-বেসরকারি ১৭টি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মিলিয়ে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত অন্তত ২২ জন মারা গেছে। এদের একটি বড় অংশ শিশু। মৃতের তালিকায় একজন চিকিৎসক, একজন নার্স, একজন গর্ভবতী, চিকিৎসকের এক ছেলে এবং শিক্ষকের এক ছেলে আছে। এসব হাসপাতালের দায়িত্বশীল শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।
সরকারি তথ্যের ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সাবরিনা প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি এ পর্যন্ত ৯টি মৃত্যুর তথ্য যাচাই করেছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে ৫টি মৃত্যু হয়েছে। আরও মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা বাকি আছে।
২০০০ সালে দেশে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। সরকারি হিসাবে ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত হয়েছিল আর মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। এরপর ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা কমতে থাকে। গত বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। মারা গিয়েছিল ২৬ জন। এর মধ্যে সরকারি হিসাবে ১৮ জুলাই পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও আইসিডিডিআরবির পরামর্শক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, সরকারের উচিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা।
দুই বছর ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ওষুধে মশা মরছে না। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা গত বছর মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা দেখেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারতে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তা অকার্যকর। তাতে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা মরে না। কিন্তু ওষুধ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়নি সিটি করপোরেশন। তখন ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আবার গবেষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। তারাও দেখতে পায়, ওষুধে মশা মরছে না। সব জেনেও সেই ওষুধ ব্যবহার করেছে সিটি করপোরেশন।
>ওষুধে মশা মরছে না
ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে
মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২২
সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন
এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সরকারি হিসাবে, মে মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮৪ জন। জুন মাসে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৭৭০। আর এ মাসের প্রথম ১৮ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৬১। এ বছর মোট আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৫৪৬ জন। গতকাল ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১ হাজার ২০৭ জন। ঢাকার বাইরে অন্তত চারটি জেলায় ডেঙ্গু জ্বরের রোগী শনাক্ত হয়েছে।
সিটি করপোরেশন কী করছে
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পাঁচটি অঞ্চলে মশা নিধনে আঞ্চলিক কমিটি করেছে। এই কমিটিতে মশকনিধনকর্মীরা এলাকাভেদে ওষুধ ছিটাবেন। জনসচেতনতা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাঁরা আজ শুক্রবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে র্যালি করবেন।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি ডেঙ্গু জ্বর ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা পক্ষ পালন করছে। এর অংশ হিসেবে ৬৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা একটি কল সেন্টার চালু করেছে। ০৯৬১১০০০৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে প্রয়োজনে তারা মুঠোফোনে পরামর্শের পাশাপাশি বাসায় গিয়েও সেবা দিচ্ছে।
কিন্তু মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ অসহায় বোধ করছে। অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে, বাজারে, রেস্তোরাঁয়, রাস্তায়—সবখানেই ডেঙ্গু জ্বরের আলোচনা কানে আসে। মানুষ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে দুষছে। তারা বলছে, সরকার ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপারে আন্তরিক নয়।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক সৈয়দ শফি আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মশা মারতে মানুষ বাড়িঘরে কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করবে, তা সরকারের জানানো উচিত।
গত বুধবার একটি রিটের শুনানিতে সিটি করপোরেশনের আইনজীবীর উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছিলেন, এটা (ডেঙ্গু) তো মহামারি হতে আর বাকি নেই। ওষুধের জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ আছে। জনগণের করের টাকার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ডেঙ্গুতে কয়েক হাজার মানুষ অসুস্থ। যার সন্তান মারা গেছে, সে বোঝে কষ্টটা কী।
ডেঙ্গুতে কোথায় কত মৃত্যু
গতকাল সকালে রাজধানীর গ্রিন রোডের বেসরকারি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক নাজিয়া হক প্রথম আলোকে জানান, এ বছর এই হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের একজন গর্ভবতী ও একজন শিশু।
গ্রিন রোডেই ল্যাবএইড হাসপাতাল। এই হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এদিন সকালে ২৮ বছর বয়সী একজন নার্স মারা যান।
একই সড়কে সেন্ট্রাল হাসপাতালের অবস্থান। হাসপাতালটি ল্যাবএইড ও গ্রিন লাইফ থেকে বেশ কাছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বেসরকারি পর্যায়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ বছর এ হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি। শমরিতা ও আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও কেউ মারা যায়নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১২ ও ১৪ জুলাই ডেঙ্গু জ্বরে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক সৈয়দ শফি আহমেদ বলেছেন, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী দুটি শিশু ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে।
বেসরকারি ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী মুঠোফোনে বলেন, অনেক রোগী বেশ জটিল পর্যায়ে হাসপাতালে আসছে। এমন চারজন রোগী এ বছর মারা গেছে।
এ মাসে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে দুটি শিশু ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে। একজনের বয়স চার বছর, অন্যজনের চার বছর দুই মাস। হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল এমরান চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের মহাপরিচালক (গণসংযোগ) সাগুফা আনোয়ার জানান, এ মাসে চার বছরের একটি শিশু ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে।
স্কয়ার হাসপাতালে ৩ জুলাই একজন চিকিৎসক মারা যান ডেঙ্গু জ্বরে। এর দুই দিন পর একটি শিশু মারা যায়। ১৫ জুলাই একজন সরকারি কর্মকর্তার শিশুসন্তান মারা যায়।
সরকার যে মৃতের তালিকা দিয়েছে, তাতে স্কয়ার হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের তথ্য আছে। এ ছাড়া বিআরবি, আসগর আলী, অ্যাপোলো ও ইবনে সিনা হাসপাতালে একজন করে মৃত্যুর উল্লেখ আছে।
‘যার পরিবারে ডেঙ্গুর রোগী ছিল বা আছে, সে জানে এই রোগের যন্ত্রণা’—এভাবেই দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে ও মশা নিধনে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। এখন রোগের প্রকোপ কমানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মৃত্যু কমানোর জন্য সঠিক চিকিৎসার ওপরই জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই প্রবীণ চিকিৎসক।