ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আগামী মাসে বা ভরা মৌসুমে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য বিশ্লেষণ করে আক্রান্তের এই অনুমিত সংখ্যা পাওয়া গেছে।
গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে সরকারি দপ্তরটি বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব রোগী সরকারি নজরদারির মধ্যে নেই। চিকিৎসা নিতে আসা মাত্র ২ শতাংশ রোগী সরকারি নজরদারির মধ্যে পড়ে। ৯৮ শতাংশের কোনো তথ্য থাকে না। আবার আক্রান্তদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই চিকিৎসা নেয় না। এই অনুমিত হিসাব তৈরিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সহায়তা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
রোগতত্ত্ববিদ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উপদেষ্টা অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের একটি অনুমিত সংখ্যা খুবই জরুরি। এতে সমস্যা অনুধাবনে সুবিধা হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়।
ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত রোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। তাদের সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), আইসিডিডিআরবি, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, রিহ্যাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করে।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দুজন বিশেষজ্ঞ গত মার্চে ডেঙ্গুতে অনুমিত আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদের খসড়া প্রতিবেদনের ওপর সরকার মতামত দিচ্ছে। খুব শিগগির এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবে। সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদ্ধতি ব্যবহার করে ভবিষ্যতেও ডেঙ্গুতে আক্রান্তের অনুমিত সংখ্যা বের করা যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির হাল নাগাদ তথ্য ও পরিসংখ্যান প্রতিদিন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। কিছু গণমাধ্যমকেও তারা তা সরবরাহ করে। কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ করি। এ ছাড়া সারা দেশের সিভিল সার্জনরা ৬৪ জেলার তথ্য পাঠান। সরকারি মেডিকেল কলেজের কাছেও তথ্য চাওয়া হয়। সব তথ্য সংকলন করে আমরা প্রকাশ করি।’
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম প্রতিদিন প্রথম আলোকে যে তথ্য পাঠায় তাতে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ১২টি সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত এবং ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য সংকলন করা হয়। সেই সংকলনের তথ্যই সরকার ব্যবহার করে।
>ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব রোগী সরকারি নজরদারির মধ্যে নেই
ঢাকার ৪৯ হাসপাতালে নতুন করে ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি
চলতি বছর ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে
এই সংকলনে সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য থাকে না। প্রথমত, ঢাকা শহরের সব বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য সরকার নিতে পারছে না। ঢাকা শহরের কয়েক শ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তথ্য সরকার পায় না। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আসা রোগীর তথ্য তাদের কাছে নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে প্রতিদিন বহু রোগী আসছে, এ রকম হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগে আসা রোগীর হিসাবও ওই সংকলনে নেই।
এখন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওই সংকলন থেকে ২ শতাংশের কম আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়। সরকারি সংকলন হিসেবে গত বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাবে গত বছর ৫ লাখ ৭ হাজার ৪০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুমের সংকলন অনুযায়ী, এ বছর ৭ হাজার ১৭৯ ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সেই হিসাবে এ বছর ২২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের অনুমিত সংখ্যা ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫০ জন।
সরকারি-বেসরকারি পাঁচজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এই প্রতিনিধির কথা হয়েছে। কেউই অনুমিত এই সংখ্যার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে এই অনুমিত সংখ্যা বের করেছে, তা আমার জানা নেই। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংকলনে অনেকেই বাদ পড়ে। ওই সংকলনে সব হাসপাতালের তথ্য থাকে না। আবার যেসব হাসপাতাল তথ্য পাঠায়, তাদের বহির্বিভাগে আসা রোগীর তথ্যও থাকে না।’
‘ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতাল সয়লাব’
রাজধানীর ঘরে ঘরে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু এখন রাজধানীর অন্যতম আলোচনার বিষয়। অনেক পরিবারে একাধিক সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। রাস্তাঘাটে, বাসে, হোটেলে, মার্কেটে, স্কুল-কলেজে ডেঙ্গু নিয়ে আলোচনা শোনা যায়। মানুষের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন মশা নিধনে বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। মশার অকার্যকর ওষুধ ব্যবহার নিয়েও মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে।
ঢাকার সরকারি-বেসরকারি ৪৯টি হাসপাতালে গতকাল নতুন করে ৪০৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এদিকে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন শাহাদাৎ হোসেন ডেঙ্গু রোগে গত রোববার রাতে ঢাকায় মারা গেছেন বলে সরকারি বার্তা সংস্থা জানিয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা ডেঙ্গু আক্রান্তের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নন।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৪৯ জন রোগী ভর্তি ছিল। মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতাল সয়লাব।’ গতকাল ওই হাসপাতালে ১৭১ জন রোগী ভর্তি ছিল।
গত কয়েক বছরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। সরকারি সংকলন অনুযায়ী, এ বছর জুলাই মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার ৫০ জন। গতকাল বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১ হাজার ৬৬৫ জন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ বছর ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।