নিবিড় পরিচর্যার জন্য ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত সাত বছরের শিশু মো. ইরতিজা শাহাদকে ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল থেকে ৪ জুলাই স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন বিকেল সাড়ে চারটায় শিশুটি মারা যায়।
স্কয়ার মৃত্যুসনদে লিখেছে, শিশুটির মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর তালিকায় স্কয়ার হাসপাতালে এ পর্যন্ত পাঁচজন মারা যাওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে। তাতে ইরতিজার মৃত্যুর তথ্য নেই।
সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুতে মৃত্যুও বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকেও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় বলে সরকারি তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ বছর মারা গেছে ২৩ জন। তাদের মধ্যে নারী ১২ জন ও শিশু ৮টি। আর প্রথম আলো অন্তত ১১০ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছে। এর মধ্যে ৬ জন বাদে বাকি ১০৪ জনের প্রাথমিক পরিচয় জানা গেছে। তাদের মধ্যে নারী ৪৪, পুরুষ ৩২ ও শিশু ২৮টি। এর আগে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ৯৩ জন মারা গিয়েছিল ২০০০ সালে। ওই বছর প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছিল।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া রোগীদের তথ্য সংগ্রহে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। কোনো কোনো হাসপাতাল লিখিত তথ্য দিয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার দেখে মৌখিকভাবে জানিয়েছে তারা। ঢাকার বাইরে জেলা সিভিল সার্জন ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তার সঙ্গে সরকারি তথ্যেরও সমন্বয় করা হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর তথ্য আইইডিসিআরে পাঠায়। ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু পর্যালোচনা আট সদস্যের কমিটি তিনটি মাপকাঠি ব্যবহার করে তা যাচাই করে। মৃত ব্যক্তির রক্তের নমুনা থাকলে তা পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয়ত, হাসপাতালে চিকিৎসার কাগজপত্র পর্যালোচনা করা হয়। আর মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছ থেকে ইতিহাস শোনা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রকাশিত তালিকা বলছে, স্কয়ার হাসপাতালে পাঁচজন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে তিনজন, ইবনে সিনা হাসপাতালে তিনজন, আসগর আলী হাসপাতালে তিনজন, ইউনাইটেড হাসপাতালে দুজন এবং হলি ফ্যামিলি, কুর্মিটোলা, ডেল্টা মেডিকেল, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, অ্যাপোলো, বিআরবি, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে একজন করে মারা গেছে।
তথ্য সংগ্রহের সময় একই হাসপাতালে একাধিকবার গিয়ে ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে। গত ২৮ জুলাই উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের আরএমসি হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, এই হাসপাতালে একজন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন। গত রোববার ওই রোগীর বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাইলে আরএমসি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ডেঙ্গু জ্বরে কোনো রোগী মারা যায়নি। আগে যার কথা বলা হয়েছিল, সেই রোগী স্ট্রোকে মারা গেছেন। মৃত মান্নাফ শেখের মৃত্যুসনদ প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে। সেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ উল্লেখ করেছে আরএমসি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
৪৪ নারী, ৩২ পুরুষ ও ২৮ শিশুর মৃত্যু
সোমবার ভোরে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শারমিন আরা। তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঢাকার আবহাওয়াবিদ নাজমুল হোসেনের স্ত্রী শারমিন। জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে পরীক্ষায় তাঁর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। রক্তের প্লাটিলেট না বাড়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য শারমিনকে ঢাকায় আনা হয়। ২ আগস্ট ফ্যাশন ডিজাইনার মালিহা মাহফুজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা যান। তিনি ৩২ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
>প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে
সরকারি হিসাবে এ বছর মারা গেছে ২৩ জন
বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১১০ জন
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সব মিলে সারা দেশে ৪৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী মারা গেছেন। আর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মারা গেছেন ৩২ জন।
ডেঙ্গু জ্বরে সবচেয়ে কম বয়সী শিশু মারা গেছে বরগুনা সদর হাসপাতালে। ২ আগস্ট তওহীদ নামের দেড় বছর বয়সী এক শিশু মারা যায় বলে বরগুনার সিভিল সার্জন নিশ্চিত করেন। গতকাল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় তিন বছরের রিয়ানা আকতার। মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিকেলে গত ৩১ জুলাই মারা যায় সাড়ে তিন বছরের সানজিদা। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালেই সাতটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
সব মিলে শিশু মারা গেছে ২৮টি। তাদের মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু মারা গেছে নয়টি। অনেক হাসপাতালে শিশুদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) না থাকায় এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে আক্রান্ত শিশুদের ছুটতে হয়েছে স্বজনদের। তাতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় বলে জানিয়েছে একাধিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
নারীর বেশি মৃত্যু হওয়ার কারণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এডিশ মশা ঘরের মশা, সে কারণে নারীর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যথেষ্ট। অন্যদিকে নারীর চিকিৎসাসেবা নেওয়ার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় কম। নানান সামাজিক কারণে নারী হাসপাতালে যায় কম, গেলেও বিলম্বে। এটাই হয়তো কারণ।’
ঢাকার বাইরে ১৬ জন
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত এক সপ্তাহে ঢাকার বাইরে মারা গেছে অন্তত ১৬ জন। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে তিনজন।
ঢাকার বাইরে প্রথম মৃত্যু হয় যশোরে গত ১৯ জুলাই। এরপর ২৯ ও ৩০ জুলাই বরিশালে তিনজন মারা যায়। আর আগস্টের ৬ দিনে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ১২ জন।