প্রথম দফা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় দফার বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিলেট অঞ্চল। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হুহু করে বাড়ছে পানি। প্লাবিত হয়েছে সিলেট নগরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা। শহরতলিতে অবস্থিত এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি পানি চলে আসায় গতকাল শুক্রবার বিকেল থেকে বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ক্লাস, পরীক্ষা ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী।
সিলেটের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে অনেক স্থানে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ও বিদ্যুতের খুঁটি তলিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলার প্রায় দুই লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছেন।
সিলেট শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় অধিকাংশ বাড়িঘরে কোমর থেকে গলাসমান পানি দেখা গেছে। কেউ কেউ ঘরের চালা কিংবা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। নৌকার অভাবে তাঁরা নিরাপদ স্থানে সরেও যেতে পারছেন না। দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
গত ১৪ মে থেকে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। চলতি মৌসুমে প্রথম দফার সে বন্যার স্থায়িত্ব ছিল দুই সপ্তাহ। এতে জেলায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছিল। তবে এবার দুর্ভোগের চিত্র এবং ক্ষয়ক্ষতি অবর্ণনীয়। পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে গতকাল জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় সেনাবাহিনী পৌঁছেছে। তবে পর্যাপ্ত জলযান না পাওয়ায় উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহম্মদ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে জানান।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, গ্রামের পর গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে আছে। কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরসমান। মাচা বানিয়ে কোনো রকমে ঘরের ভেতরে লোকজন আছেন। কেউ কেউ নৌকায় করে বা সাঁতরে নিরাপদ স্থানে যাচ্ছেন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। নৌকার অভাবে অনেকে ঘর থেকে বেরোতে পারছেন না। পানিতে চুলা তলিয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ ঘরেই রান্নাবান্না বন্ধ।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করছে। যাঁদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে, তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা অন্য নিরাপদ স্থানে যেতে বলা হচ্ছে। খাদ্যসংকট দূর করতে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী কাজ করবে।
বানভাসি কিছু মানুষ জানান, জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, সদর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা সবচেয়ে বেশি বন্যাকবলিত। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া অনেকের অভিযোগ, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা কোনো খাবার পাননি।
এদিকে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে সিলেটের দুটি স্থানে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তীব্র স্রোতে সিলেট সদর উপজেলার নলকট গ্রামের আবদুল হাদি (১৮) নামের এক তরুণ নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁকে উদ্ধারে সিলেট ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার তৎপরতা চালালে গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের আমেনা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন তাঁর ডুবে যাওয়া ঘরের দিকে। তাঁর কোলে ছয় বছরের নাতি। তখন মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মাঝেমধে৵ বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। আমেনার কাপড় ভিজে জবজবে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি নিজের ঘর প্লাবিত হওয়ার কথা বলতে বলতে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর কেবল চোখ মোছেন। খানিক পরে আমেনা বলেন, ‘সব শেষ অই গেছে। ঘর ডুবি গেছে! জিনিসপত্র ভাসি গেছে। কী খাইমু, কই থাকমু?’ এরপর আর কোনো কথাই বলতে পারেননি তিনি।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমেনা বেগমের সঙ্গে কথা হয় সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার এলাকায়। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের যে স্থানে দাঁড়িয়ে আমেনার সঙ্গে কথা হয়, তখন সেখানে ছিল হাঁটুসমান পানি। ওই রাস্তা ধরে আমেনার মতো অনেককেই গতকাল দিনভর হেঁটে হেঁটে সিলেট শহরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যেতে দেখা গেছে।
বন্যার পানিতে অনেক স্থানে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ও বিদু৵তের খুঁটি তলিয়ে গেছে। সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলার প্রায় দুই লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সিলেট বিভাগের চার জেলায় পিডিবির অধীনে প্রায় চার লাখ গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে সিলেটের এক লাখ গ্রাহক বর্তমানে বিদ্যুৎহীন। অন্যদিকে সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আরও প্রায় ৯২ হাজার ৫০০ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছেন। যেখানে বন্যার অবনতি হবে, সেখানেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে বলে তাঁরা জানান।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির গতকাল বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট নগরের কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র এরই মধ্যে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের এক থেকে দেড় ইঞ্চি নিচে পানি আছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। তাই নিয়ন্ত্রণকক্ষে পানি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা আছে। এমনটি হলে পুরো সিলেট জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে।
সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি পানি চলে আসায় বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় এই বিমানবন্দর থেকে বিমান উড্ডয়ন কিংবা অবতরণ করবে না বলে জানান বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানি বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। এ ছাড়া বিমান চলাচল বন্ধ রাখার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিমানবন্দরের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সুরক্ষা দেওয়া। গতকাল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বন্যার পানি বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি পর্যন্ত ছিল।
এদিকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সব বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সকালে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ১৯ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা শাবিপ্রবির দুটি হলে বন্যার পানিতে আটকে পড়া ছাত্রীদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন।