প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। ডায়াবেটিসের বিশেষায়িত সেবার এত বড় হাসপাতাল গোটা বিশ্বে কম।
ডায়াবেটিস চিকিৎসার কথা উঠলেই অনেকের চোখের সামনে বারডেম হাসপাতালের চেহারা ভেসে ওঠে। বিপুলসংখ্যক ডায়াবেটিস রোগী এখানে প্রতিদিন সেবা নেন। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে ডায়াবেটিসের বিশেষায়িত চিকিৎসার আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে রাজধানীর শাহবাগের এই প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন (২০১৯–২০২০) বলছে, বারডেমে নিবন্ধনকৃত রোগীর সংখ্যা ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫২৬। আগের বছরে ১৯ হাজার ৪৬৯ জন নতুন রোগী নিবন্ধন করেছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৫৩ জন নতুন ডায়াবেটিস রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিবন্ধন করছেন। বছরে নিবন্ধন করা রোগী বাড়ছে প্রায় তিন শতাংশ হারে। এঁদের বড় অংশটি দরিদ্র, এঁরা বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পান।
প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। ডায়াবেটিসের বিশেষায়িত সেবার এত বড় হাসপাতাল গোটা বিশ্বে কম আছে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বারডেম হাসপাতালের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে এখানে দরিদ্র ও ধনী একই মানের সেবা পান। যে সেবা ধনী বা দরিদ্রকে সমানভাবে দেওয়া সম্ভব হবে না, সেই সেবা বারডেম হাসপাতালে চালু করা হয় না। সম্ভবত এ রকম হাসপাতাল দেশে আর নেই।’
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের তাত্ত্বিক অনেক কথাই বলা হয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বারডেম অনন্য উদাহরণ।হোসেন জিল্লুর রহমান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের উদ্যোগে ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন সমিতির নাম ছিল ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন ফর পাকিস্তান। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অধ্যাপক ইব্রাহিম এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে দরিদ্র ডায়াবেটিস রোগীরা বিনা মূল্যে সেবা পাবেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিজের বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষকে সমিতির ব্যবহারের জন্য প্রস্তাব করেন। ওই বাড়িতেই ডায়াবেটিস সেবার জন্য বহির্বিভাগ চালু করেন। সেখানেই প্রথম শুরু হয় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা।
পাকিস্তান আমলে সেগুনবাগিচায় হাসপাতালের জন্য কিছু জমি সরকার দিয়েছিল সমিতিকে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে সমিতির দুটো গবেষণা প্রকল্প ছিল। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে এবং ১৯৭৩–৭৪ অর্থবছরের প্রথম কিস্তির তিন লাখ টাকা ছাড় করে। শাহবাগে বর্তমান জায়গায় হাসপাতাল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৮০ সালে। ২০১৩ সালে সেগুনবাগিচায় বারডেম-২ হাসপাতাল চালু হয়। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে স্বতন্ত্র নয়টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে বারডেম (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডারস)।
পরীক্ষায় নতুন রোগীর ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়ার পর তাঁকে প্রথমেই নিবন্ধন করা হয়। নিবন্ধনের সময় রোগীর স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ইতিহাস নেওয়া হয়। এরপর প্রত্যেক রোগীকে একটি করে গাইড বই দেওয়া হয়। বইয়ে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত তথ্য ছাড়াও পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্য লেখা হয়। পরবর্তী কোন তারিখে হাসপাতালে আসতে হবে, তারও উল্লেখ থাকে।
হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৭১৬। এগুলোর মধ্যে কিছু শয্যা দরিদ্র রোগীদের জন্য। দরিদ্রদের বিনা মূল্যের শয্যাগুলো ১০০ শতাংশ পূর্ণ থাকে; অন্য শয্যাগুলো ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পূর্ণ থাকে। প্রতিদিন এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে যে ৩ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন, তাঁদের একটি বড় অংশ আসেন নিয়মিত চিকিৎসায়।
নিবন্ধিত ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫২৬ জনের মধ্যে প্রায় ১ লাখ রোগী বিনা মূল্যে সেবা পান। তা ছাড়া রোগীর আর্থিক অবস্থাভেদে ইনসুলিন, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেওয়া হয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবছর ডায়াবেটিক সমিতিকে কিছু অর্থ দেয়। সেই অর্থের একটি অংশ পায় বারডেম হাসপাতাল। কেবিন থেকে এবং অন্য শয্যা থেকে (দরিদ্রদের জন্য রাখা শয্যা ছাড়া) আয় করে বারডেম কর্তৃপক্ষ। সেই আয় দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়। ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ থেকেও আয় হয়। তারও একটি অংশ ব্যয় করা হয় দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসায়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের তাত্ত্বিক অনেক কথাই বলা হয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বারডেম অনন্য উদাহরণ। বারডেম ঠিক বেসরকারি হাসপাতাল বা এনজিওর মতো নয়। সামাজিক দায়িত্ব পালনের দিকটি খুবই শক্তিশালী। এই দায়িত্ব তারা পালন করছে স্বাস্থ্যসেবার মানের সঙ্গে সমঝোতা না করেই।’
সেবার জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বারডেম। ১৯৮২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারডেমকে তাদের সহযোগী কেন্দ্রের মর্যাদা দেয়। এশীয় অঞ্চলে বারডেমই প্রথম হাসপাতাল, যেটি ‘ডব্লিউএইচও কোলাবরেটিং সেন্টার ফর প্রিভেনশন, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল অব ডায়াবেটিস’-এর স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৮৩ সালে বারডেম স্বাধীনতা পদক লাভ করে। ২০০৪ সালে ইবনে সিনা পুরস্কার পায় হাসপাতালটি। এ ছাড়া ২০১৪ সালে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বিশেষ পদক দেয় এই হাসপাতালকে।