স্বাস্থ্য খাত ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে জাতীয় সংসদে তীব্র সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলের সদস্যরা। একের পর এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের যৌক্তিকতা, সেখানকার শিক্ষার মান, চিকিৎসকদের রাজনীতি করা, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়, চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস—এমন বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সদস্যরা। আজ বুধবার জাতীয় সংসদে বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা স্বাস্থ্য খাত ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেন।
মেডিকেল কলেজ নিয়ে একটি বিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেহাল। যাঁরা সরকারি হাসপাতালে কর্মরত, তাঁরাই আজকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে হারুন বলেন, ‘এতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এইগুলো মানসম্মত? আজকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যাঁরা শিক্ষা অর্জন করছেন, তাঁরা কজন বিসিএসে টিকছেন? ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? যেসব ছাত্র অনিয়ম করেন, সেখানে ভর্তি হয়েছেন যাঁরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে জ্ঞান অর্জন করবেন, সে ব্যাপারে সরকার বলেছিল এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সিআইডি রিপোর্ট দিচ্ছে এখানে লাগাতারভাবে ৭ বছর অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে।’
বিএনপি থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, ‘দেশ যায় কোন দিকে, মানুষের সমস্যা যায় কোন দিকে, মানুষ কোন বিষয় নিয়ে সাফার (ভোগান্তি) করছে আর আমরা আলোচনা করছি কী? অদ্ভুত লাগে। করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে কতগুলো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেছে, সেই খবর কি আমাদের কাছে আছে? করোনাকালে হাতে গোনা কিছু রিপোর্ট আসছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনায় সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।’
বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, করোনাকালে যে কয়টি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মানুষকে সর্বস্বান্ত করার অভিযোগ এসেছে, তার মধ্যে সব থেকে শীর্ষে আছে সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যের হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ। এই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরকার ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে তার কর্মীদের হাতে এমনভাবে তুলে দিচ্ছে যে চট্টগ্রামে সিআরবি নামে যে জায়গাটি আছে, যেটিকে চট্টগ্রামের অক্সিজেন বলা হয়, সেটাও না কি এখন বেসরকারি হাসপাতাল করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হবে।
চিকিৎসকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘বিএনপি করে গিয়েছিল ড্যাব, আওয়ামী লীগ এসে করেছে স্বাচিপ। সে ক্ষেত্রে আমরা কী কারণে বসে থাকছি? এই আইনের মধ্যে যদি উনি আনতো যে ডাক্তাররা এবং বৈজ্ঞানিকেরা রাজনীতি করতে পারবে না, তাহলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেটা আনা হয় নাই। ডাক্তাররা যদি এই দেশে রাজনীতি করে, তাহলে আমরা কী করব? আমাদের কাজটা কী? ওনারা চলে আসুক রাজনীতি করতে। যারা ভালো ছাত্র তারা ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করে, তাহলে আমরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছি।’
বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাংসদ মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি, রাজনীতিবিদের জায়গায় থাকব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনশৃঙ্খলার জায়গায় থাকবে। ডাক্তাররা ডাক্তারদের জায়গায় থাকবে। সেই জায়গাগুলোকে রিপেয়ার করা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো তারা যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে টাকা রোজগারের একটি পথ খুলে নিয়েছে, সেখানে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, ‘অ্যাডমিন ক্যাডারের লোক, জজ বা পুলিশ ক্যাডারের লোক, তাঁরা তো চাকরি করে প্রাইভেট কোনো বিষয়ে কনসালটেন্সি করতে পারবেন না। ডাক্তাররা বিসিএস অফিসার হয়ে তাঁর ডিউটির পর যদি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর যে মূল কাজ, সেটা ঠিক থাকে না। এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। মন্ত্রীকে বলব, যদি উপকার করতে চান, তাহলে ডাক্তার সাহেবদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা আপনারা দয়া করে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। জনগণের পয়সা দিয়ে তাঁদের বেতন দেবেন, তাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন, এটা আমরা করতে পারি না।’
মুজিবুল হক রাজধানীর দুটি হাসপাতালের নাম উল্লেখ করে এগুলোকে ডাকাত বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি ঢাকা শহরে এসব হাসপাতাল ডাকাত। এইখানে দেখা যায়, যখন মানুষ চিকিৎসা করতে যায়, তখন দেখা যায় এক লাখ, দুই লাখ, দশ লাখ টাকা বিল করে তাদের আটকে রাখে। মাননীয় মন্ত্রী আপনি একটা কমিটি করে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য একটা রেট করে দেন। এইগুলো বন্ধ হওয়া দরকার।’
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, বেসরকারি মেডিকেল ও হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেই। টেকনোলজিস্টের ব্যাপক সংকট। ২০২০ সালের পরীক্ষার ফলাফল এখনো দেওয়া হয়নি। অনেক মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি এয়ারপোর্টে পিসিআর ল্যাব দিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পরও প্রবাসীদের ঘেরাও করতে হয়েছে।
সাংসদদের এসব বক্তব্যের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালিক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দেশের প্রতিটি কলেজে মেডিকেল কলেজ হবে। সেটা পর্যায়ক্রমে হবে। সেই অনুযায়ী ৩৮টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সব জেলায় হয়ে যাবে।
মন্ত্রী বলেন, ‘ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। স্বাচিপ, বিএমএ রয়েছে। রাজনীতি তো সবাই করতে পারে। প্রকৌশলী, আইনজীবীরা রাজনীতি করতে পারেন। সেই অনুযায়ী চিকিৎসকেরা তাঁদের অ্যাসোসিয়েশন করলে, তাতে কোনো দোষ বা অন্যায় নেই। তাঁরা সেবা দিচ্ছেন।’
পরে ‘মেডিকেল কলেজ (গভর্নিং বডিস) (রিপিল) বিল-২০২১’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর আগে বিরোধী দলের সদস্যদের আনা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব ও সংশোধনীগুলো নিষ্পত্তি করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।