ডাকসু নির্বাচন কেমন হবে সেটাই আলোচনা

>
  • দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ
  • ঝিমিয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সঞ্চার
  • নির্বাচন নিয়ে সংশয় অনেকটা কেটে গেছে
  • তবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটছে না
  • নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের জট খোলার প্রেক্ষাপটে এখন বিরোধী সব পক্ষই একযোগে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ চাইছে। একদিকে সেই আলোচনা চলছে, অন্যদিকে ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্ররাজনীতিতে ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে ডাকসু নির্বাচনের হাওয়া 

বইছে জোরেশোরে। এই নির্বাচনে এবার সম্ভাব্য ভোটার ৪০ হাজার।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সঞ্চার করেছে। সব ছাত্রসংগঠনের নেতাদের ডেকে আলোচনা, রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ, গঠনতন্ত্র সংশোধন, আচরণবিধি প্রণয়নে কমিটি এবং দুই দফায় পরিবেশ পরিষদের সভা হওয়ার পর নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ-সংশয় অনেকটাই কেটে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান গতকাল সোমবার ১৩টি ছাত্রসংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে দ্বিতীয় দফা পরিবেশ পরিষদের বৈঠক করেছেন। আবাসিক হলগুলোর প্রাধ্যক্ষ ও ডাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত বিভিন্ন কমিটির সদস্যরাও সেখানে ছিলেন। প্রায় চার ঘণ্টার আলোচনায় সংগঠনগুলোর পাল্টাপাল্টি দাবি এবং প্রশাসনের অবস্থান বৈঠকে খানিকটা উত্তাপ ছড়ায়। বিশেষ করে আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ছাত্রনেতাদের কয়েকজন। জবাবে হল প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন শিক্ষক দাবি করেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ আছে।

বৈঠকে সব ছাত্রসংগঠনের নেতারাই বলছেন, প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁরা নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে আস্থা পাচ্ছেন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাড়া অন্যদের শঙ্কা কাটছে না। বৈঠক শেষে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মধুর ক্যানটিন ও আবাসিক হলগুলোতে সহাবস্থান নিশ্চিত হবে, এমন একটি সিদ্ধান্ত পরিবেশ পরিষদে কার্যকর হওয়ার পরই ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে। ছাত্রলীগ আমাদের মধুর ক্যানটিনে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আগামীকাল (আজ) থেকেই মধুর ক্যানটিনে আসতে চাই৷’

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেছেন, ‘কথা দিচ্ছি, ছাত্রদল নেতা-কর্মী পরিচয়ে কোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী হলে থাকলে আমরা কোনো ধরনের সমস্যা করব না৷’ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরীসহ ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতারা গতকাল একসঙ্গে গণমাধ্যমের সামনে আসেন।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ-খালেকুজ্জামান), বাসদ (মার্ক্সবাদী) সমর্থিত ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের নেতারাও হলে সহাবস্থান, প্রার্থিতার যোগ্যতা শিথিল করা, একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র করা, সভাপতি ও সহসভাপতির (ভিপি) ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন হবে—এ নিয়ে প্রশাসনের বক্তব্যে তাঁরা আস্থা পাচ্ছেন। কিন্তু সহ–অবস্থানসহ অন্যান্য বিষয় সমাধান না করে নির্বাচন হলে সেটি প্রভাবমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হবে না।

নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক

নির্বাচনে কারা প্রার্থী হতে পারবেন, কারা পারবেন না, তা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনে গঠিত কমিটি ইতিমধ্যে তাদের মতামত দিয়ে বলেছে, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাইরে যেন প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না থাকে। তবে ‘নিয়মিত শিক্ষার্থী’র সংজ্ঞা সবাই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। গতকালের পরিবেশ পরিষদের সভায়ও দুই ধরনের আলোচনা হয়েছে। এক পক্ষ বলছে, যাঁরা ডাকসু ও হল সংসদের ফি দেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত শিক্ষার্থী। সে হিসেবে তাঁরা সবাই নিয়মিত। এর মধ্যে একাধিক স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) করা শিক্ষার্থী যেমন আছেন, তেমনি সান্ধ্যকোর্সের শিক্ষার্থীরাও অন্তর্ভুক্ত থাকেন।

অপর পক্ষের মত হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার পদ্ধতির নিয়ম অনুযায়ী চার বছরের স্নাতক করতে ছয় বছর এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর করতে দুই বছর সময় বেঁধে দেওয়া আছে। এর বাইরে সবাই অনিয়মিত শিক্ষার্থী। প্রশাসনের একাধিক নীতিনির্ধারকের কাছ থেকেও এ ধরনের বক্তব্য এসেছে।

গতকালের সভা শেষে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যাঁরা ভোটার হবেন, তাঁরাই যেন প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান৷ এই পয়েন্টে আমরা সবাই একমত৷ তবে সব বিষয়ে সিন্ডিকেটের সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

প্রভাবমুক্ত নির্বাচন, সহ-অবস্থান

ক্যাম্পাসজুড়ে এ মুহূর্তের আলোচনা হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচন কতটা প্রভাবমুক্ত হবে। একদিকে আবাসিক হলগুলোতে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, অন্যদিকে ক্যাম্পাসে অন্যতম বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ২০১০ সাল থেকে ক্যাম্পাসের বাইরে। অন্য দলগুলোরও অভিযোগ, হলে সিট বরাদ্দের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের কর্মী-সমর্থক বাড়িয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সহাবস্থান জরুরি।

ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র আবাসিক হলগুলোতে না করে একাডেমিক ভবনে করার দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

উপাচার্য এ বিষয়ে বলেছেন, ‘গঠনতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলো পরিবর্তন করা একটু কঠিন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য একটু সময় রয়েছে।’

ডাকসু নির্বাচনের আদ্যোপান্ত

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, ডাকসু প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৪ সালে। ১৯৫৩ সালে প্রথম নির্বাচন হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার ডাকসু নির্বাচন হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর গত ২৮ বছরে আর এই ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি।

এর মধ্যে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সাত বছরে তিনবার তফসিল ঘোষণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি। কখনো ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন চায়নি, কখনো বিরোধী দলে থাকা ছাত্রসংগঠনের তীব্র আপত্তিসহ বিভিন্ন কারণে নির্বাচনের আয়োজন করেনি কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ওই সময় পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী ২০ বছরে পাঁচজন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করলেও কেউ আর তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি।

অবশ্য এর মধ্যে ডাকসু খুলে দেওয়ার জন্য একাধিকবার আন্দোলন হয়েছে। ২০১২ সালে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ তৈরি করে লাগাতার কর্মসূচিও চলে কয়েক মাস। ২০১২ সালের ২১ মার্চ হাইকোর্টে আন্দোলনকারী ২৫ শিক্ষার্থী রিট আবেদন করেন।

২০১৭ সালে আবারও শুরুতে ‘শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ ও পরে ‘ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে ডাকসুর দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর বামপন্থী সংগঠনগুলো ও আন্দোলনকারীরা মিলে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেন।

এর মধ্যে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ওয়ালিদ আশরাফ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকোর্সের এক শিক্ষার্থী একক অনশন শুরু করার পর থেকে ডাকসুর দাবিটি জোরালো হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে শিক্ষার্থীদের রিট আবেদনটিতে সাড়া দিয়ে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করতে আদেশ দেন। অবশ্য আগের বছর (২০১৭) ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক মো. মুশতাক হোসেন এবং একজন শিক্ষার্থীও হাইকোর্টে পৃথক রিট আবেদন করেছিলেন।

নির্বাচনের ঘোষণা–প্রত্যাশা

ডাকসু নির্বাচনের দাবি জোরালো হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ ফেব্রুয়ারির সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পরবর্তী বছরের (২০১৯) মার্চের মধ্যে নির্বাচন হবে। ১৬ সেপ্টেম্বর ডাকসু নিয়ে আলোচনার জন্য পরিবেশ পরিষদের বৈঠক ডেকে উপাচার্য মার্চে নির্বাচনের ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনে কমিটি গঠন, প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, আচরণবিধি প্রণয়নসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সবশেষে গতকাল পরিবেশ পরিষদের দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক শেষে উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ৩১ মার্চকে লক্ষ্য রেখেই এগোচ্ছি। কাজের পরিধি বিবেচনা করে তফসিলের তারিখ ঘোষণা করা হবে।’

ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামগ্রিক পরিবেশ এখনো স্বাভাবিক নয়। এর প্রমাণ ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে করার দাবি তোলা।’ তাঁর মতে, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি৷ এই নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তার দায় বর্তমান সরকারের ঘাড়েও বর্তাবে।