ট্রাকও আসছে দেরিতে, পণ্য পেতে অপেক্ষা আরও বেড়েছে

প্রায় দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর টিসিবির ট্রাক থেকে সবার আগে পণ্য কিনতে পেরেছেন লতিফা বেগম। এসব পণ্য বাসায় নিতে তাঁকে সহযোগিতা করছে মেয়ে নুসরাত জাহান। খাজে দেওয়ান দ্বিতীয় লেন, লালবাগ, ২৭ মার্চ
ছবি: দীপু মালাকার

স্কুল ছুটির পর মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মা মুক্তা আক্তার। স্কুল গেট থেকে কিছুটা পথ এগোনোর পরই দেখেন টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাক এসে থেমেছে। দেরি না করে ট্রাকের সামনে অন্যদের সঙ্গে তিনিও লাইনে দাঁড়িয়ে যান। তখন বেলা প্রায় দুইটা। ট্রাকে থাকা (টিসিবির ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পরিবেশকের কর্মীরা সব গুছিয়ে বিক্রি শুরু করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল চারটা বেজে যায়।

মুক্তা আক্তার লাইনের শুরুর দিকেই ছিলেন। মা যখন অন্য নারীদের সঙ্গে লাইনে পণ্য পাওয়ার অপেক্ষায়, তখন ছোট্ট তাহিরা ইসলাম কখনো খেলছিল, কখনো মাটিতে বসেই বই খুলে পড়ছিল। এভাবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা খেলে-পড়ে সময় কাটিয়েছে সে। মাঝে একবার ফুচকা বিক্রেতাকে দেখে মায়ের কাছে খাওয়ার আবদার করে সে। প্রথমে মা রাজি না হলেও পরে তাকে ফুচকা কিনে খাওয়ানো হয়। এই দৃশ্য গতকাল রোববারের, রাজধানীর মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি খেলার মাঠের।

মুক্তা আক্তার গৃহিণী। তাঁর স্বামী সুমন হোসেন একটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার (তত্ত্বাবধায়ক)। বেতন মাসে ১১ হাজার টাকা। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা চলে যায় বাসাভাড়ার পেছনে। টিঅ্যান্ডটি আনসার ক্যাম্পের পাশের একটি বাসায় এক কক্ষে সাবলেট (সহভাড়াটে) থাকেন তাঁরা। একমাত্র মেয়ে তাহিরা পড়ে মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে। মেয়ের স্কুলের মাসিক বেতন ৮০০ টাকা।

মুক্তা আক্তার বলেন, মেয়ে মুরগির মাংস পছন্দ করে। চেষ্টা করেন সপ্তাহে অন্তত একবার ব্রয়লার মুরগি কিনতে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহেও মেয়েকে মুরগির মাংস খাওয়াতে পারেননি। আরও বললেন, সয়াবিন তেলের দাম বাড়ায় আগে মাসে পাঁচ কেজির জায়গায় এখন আড়াই কেজি দিয়ে চালাতে হচ্ছে। এক কেজি মসুর ডালের বদলে এখন ৫০০ গ্রাম কেনেন। আগে মসুর ডাল ভুনা করে খেতেন, এখন পাতলা করে রান্না করেন।

৮৪০ টাকায় মোট ছয়টি পণ্যের ‘প্যাকেজ’ কিনে যখন মুক্তা আক্তার বাসার পথ ধরেন, তখন বিকেল প্রায় পৌনে পাঁচটা। মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি মাঠে পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবির পরিবেশক মেসার্স খালেক এন্টারপ্রাইজ। তাদের প্যাকেজে ছিল চার কেজি ছোলা (২০০ টাকা), দুই কেজি মসুর ডাল (১৩০ টাকা), দুই কেজি সয়াবিন তেল (২২০ টাকা), চিনি দুই কেজি (১১০ টাকা), খেজুর এক কেজি (৮০ টাকা) ও পেঁয়াজ পাঁচ কেজি (১০০ টাকা)।

পণ্য বিক্রিতে দেরি হওয়ার বিষয়ে খালেক এন্টারপ্রাইজের বিক্রয় প্রতিনিধি সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, টিসিবির গুদাম থেকে পণ্য নিয়ে ট্রাকে ওঠাতেই বেলা একটা বেজে গেছে। এখানে এসে ২৫০টি আলাদা প্যাকেট করতে আরও দেড়-দুই ঘণ্টা লেগেছে।

গতকাল দুপুর থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি মাঠে ক্রেতা ছিলেন প্রায় ১৫০ জন। উপস্থিত ক্রেতাদের কয়েকজন বললেন, ট্রাক দেরিতে আসায় অনেকে মনে করেছে অন্য কোথাও হয়তো ট্রাক দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ভিড় একটু কম। তবে পণ্য কেনার পর পেঁয়াজের মান নিয়ে বেশির ভাগ ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

রিনা নামের একজন গৃহবধূ বলেন, পাঁচ কেজি পেঁয়াজের মধ্যে প্রায় এক কেজিই পচা। পণ্য কেনার পর পচা পেঁয়াজ আলাদা করে তা বিক্রয়কর্মীদের দেখান। তখন বিক্রয়কর্মী সোহেল রানা বলেন, তাঁদের কিছু করার নেই। তাঁরা যা আনেন, তা-ই বিক্রি করেন।

লালবাগে ট্রাক এল দেরিতে, বিক্রির জন্য আরও অপেক্ষা

পুরার ঢাকার লালবাগের সিরাজউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাক যখন এসে পৌঁছায়, তখন গতকাল বিকেল পৌনে চারটা। সেখানে তখন ৪০-৫০ জন ছিলেন। তাঁদের একজন লতিফা বেগম। এক হাজার টাকা ধার করে লাইনে দাঁড়ান তিনি। নারীদের লাইনে তিনি ছিলেন সবার আগে। ভেবেছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই পণ্য কিনে বাসায় ফিরবেন।

কিন্তু ট্রাকের পেছনে লাইনে তাঁকে প্রায় দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কারণ, টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধিরা পণ্য মাপামাপিতে অনেক সময় নেন। বেজে যায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। এরপর শুরু হয় বিক্রি।

লতিফা বেগম গৃহিণী। থাকেন লালবাগের খাজে দেওয়ান এলাকার দ্বিতীয় লেনের একটি ভাড়া বাসায়। তাঁর স্বামী মো. শহীদের প্লাস্টিকের ছোট ব্যবসা আছে কামরাঙ্গীরচরে। তাঁরা সাত হাজার টাকার (বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ) এক কক্ষের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন।

বিক্রি শুরু করতে দেরি হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে লতিফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা (বিক্রয়কর্মী) সব খেজুর মাপা শেষে বিক্রি শুরু করবে বলে জানিয়েছে। অন্য সময় ট্রাক দাঁড়ানোর ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যেই বিক্রি শুরু হয়।’

লালবাগে টিসিবির পরিবেশক ছিল মেসার্স ডোমেস্টিক এন্টারপ্রাইজ। বিক্রি শুরু করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে পরিবেশকের প্রতিনিধি মো. সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, তেল (বোতলে থাকে) ছাড়া বাকি পাঁচটি পণ্য নির্ধারিত পরিমাণে মেপে প্যাকেট করতে হয়। আগে তেল ছাড়া তিনটি পণ্য মাপতে হতো। যে কারণে এখন সব ট্রাকেই বিক্রির প্রস্তুতি নিতে সময় বেশি লাগছে।